২১/৩/২০০৭
ভূমিকাঃ
বাংলাদেশে সকল ধর্মের মানুষ
শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ধর্ম
পালন এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যে বা যারা
বোমাবাজি, সন্ত্রাস, গুপ্তহত্যাসহ নানাবিধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্ট করছে, সর্বত্র ত্রাস ও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপন প্রক্রিয়া নস্যাৎ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে তাদের
ব্যাপারে আজকের এই ঐতিহাসিক উলামা সম্মেলন নিম্নোক্ত প্রস্তাব অনুমোদন করছে।
১. যে বা যারা শান্তিপূর্ণ সুন্দর পরিবেশ বিনষ্ট করে তা অশান্ত করতে
চায়; দেশে বিশৃঙ্খলা ও ফেৎনার সৃষ্টি করে, এরা ইসলামের দুশমন। আল কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী আখিরাতে এদের জন্য রয়েছে
কঠোরতম শাস্তি। এদের অপকর্ম রোধে এদের
বিরুদ্ধে প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত জরুরী। এদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে কারীমের সূরা মায়িদার ৩৩ নং আয়াতে
সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে।
২. বর্তমানে যে বা যারা বোমাবাজি অথবা অন্য কোন আইনবহির্ভূত পন্থায় মানুষ
হত্যা করছে; পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতের আলোকে এরা গোটা
মানবজাতির হত্যাকারী। এরা শুধু
ইসলামের দুশমন নয়; বরং গোটা মানবজাতির দুশমন।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
“সংগত কারণ ছাড়া
(কারো খুনের বদলা
কিংবা পৃথিবীতে সন্ত্রাস সৃষ্টির অপরাধ ব্যতীত) যদি কেউ কোন একটি
মানুষ হত্যা করে সে যেন সমগ্র
মানব সত্বাকে হত্যা
করে। অপরদিকে যে ব্যক্তি অন্যায় হত্যার কবল থেকে একটি
জীবন রক্ষার ব্যবস্থা করলো, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করলো।” (সূরা আল মায়েদা, আয়াতঃ ৩২)
আল্লাহ তা‘আলা অন্য আয়াতে
এরশাদ করেন- “যে মানুষ হত্যাকে আল্লাহ্ তা‘আলা হারাম
করেছেন অন্যায়ভাবে তাকে হত্যা করোনা।” (সূরা আল আনআম, আয়াতঃ
১৫১)
৩. কোন দেশ,
জাতি বা গোষ্ঠীর প্রতি কোনভাবে শত্র“তা সৃষ্টি হয়ে থাকলে ন্যায়ানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় তা নিরসনের চেষ্টা চালাতে হবে, অন্যায় ইনসাফ
বহির্ভূত পন্থায় তাদের
সাথে আচরণ করা সম্পূর্ণ নাজায়েয। আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনÑ“কোন জাতির প্রতি
শত্র“তা যেন তোমাদেরকে বেইনসাফী করতে প্ররোচিত না করে। ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী।” (সূরা
মায়িদা, আয়াত নং-৮)
আল্লাহ্ তা‘আলা অন্যত্র বলেনঃ
“দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ হতে বের করে দেয়নি তাদের
প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায় বিচার করতে
আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে নিষেধ করেন
না। আল্লাহ তা‘আলা ন্যায় পরায়নদেরকে ভালবাসেন। (সূরা মুমতাহিনা, ০৮)
৪. একটি শান্তিপূর্ণ সমাজে, যেখানে সকল নাগরিক তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার পুরোপুরি ভোগ করে থাকে, সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি কোন ক্রমেই অনুমোদন যোগ্য
নয়। এরূপ ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রতিটি নাগরিকের একান্ত কর্তব্য। ইসলামের জিহাদ,
কিতাল বা লড়াই
হলো শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য,
এগুলো বিঘিœত করার জন্য নয়।
একদা এক ব্যক্তি হযরত সা’দ রাদি আল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করলেন,
আল্লাহ তা‘আলা কি বলেন নি যে “তোমরা তাদের
বিরুদ্ধে লড়াই কর যতক্ষণ না ফিতনা
ফাসাদ দূরীভূত হয় এবং দ্বীন আল্লাহরই জন্য হয়।” তখন হযরত সা‘দ রাদি আল্লাহু আনহু
বললেন, “আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত লড়াই করেছি
যতক্ষণ না ফিতনা
ফাসাদ নির্মূল হয়েছে;
আর তুমি ও তোমার সাথীগণ লড়াই
করতে চাও ফিতনা
সৃষ্টির জন্য।” এতে বুঝা যায় একটি সভ্য, স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ অবস্থানে জিহাদ
ও ক্বিতালের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অবকাশ
নেই।
৫. দেশের সাধারণ নাগরিকদের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার
লক্ষ্যে সন্ত্রাসীদেরকে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি
এ সম্মেলন উদাত্ত আহবান জানাচ্ছে।
৬. বর্তমানে যারা বোমাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে এদেরকে আইনের হাতে
সোপর্দ করা অতি জরুরী। এদের অবস্থান এবং কার্যকলাপ সম্পর্কে জানা
থাকলে তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করার জন্য এ সম্মেলন সকল শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানাচ্ছে।
৭. ইসলাম সহজ-সরল ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন
ব্যবস্থা। একগুয়েমি ও চরমপন্থা ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের জন্য সহজ সাধ্যতা চান;
কাঠিন্য চান না। আল্লাহ তা‘আলা বলেনÑ “এটি তোমাদের রবের
পক্ষ থেকে সহজ ব্যবস্থা ও অনুগ্রহ।” (সূরা
আল-বাক্বারা, আয়াতঃ ১৭৮) তিনি ইরশাদ
করেন- “আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য
সহজ করতে চান এবং তোমাদের জন্য
জটিলতা চান না।”
(সূরা আল-বাক্বারা, আয়াতঃ ১৮৫)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন- “আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর কোন অসুবিধা চাপিয়ে দিতে
চান না।” (সূরা মায়িদা, আয়াতঃ ৬) তিনি আরো বলেন-
“আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ভার হালকা
করতে চান, কারণ
মানুষকে দুর্বলভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।” (সূরা আন নিসা,
আয়াত ২৮)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “সহজ কর, কঠিন করো না, সুসংবাদ প্রদান কর, হতাশ করো না।” হাদীস...
৮. ইদানিং সমাজে
ইসলাম, ঈমান, কুফর,
নিফাক, শিরক, জাহিলিয়াত, জিহাদ ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু লোকের মুখে
বিভ্রান্তিমূলক ব্যাখ্যা শোনা যাচ্ছে। এর ফলে আবির্ভাব ঘটছে চরমপন্থার। এ সম্মেলন মনে করে ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে অগভীর জ্ঞান,
আরাবী ভাষায় ব্যুৎপত্তির অভাব এই বিভ্রান্তি এবং ভ্রান্ত ব্যাখ্যার জন্য বহুলাংশে দায়ী। অতএব
গভীর জ্ঞানী লোকদের ব্যাখ্যা পরিত্যাগ করে যারা ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে নতুন নতুন ব্যাখ্যা পেশ করে ইসলাম সম্পর্কে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য
দেশের আপামর জনসাধারণের প্রতি এ মহা সম্মেলন উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে।
৯. বাড়াবাড়ি ও অগভীর জ্ঞানের ফলে আজকাল এক শ্রেণীর লোক নিয়মতান্ত্রিক পন্থার পরিবর্তে সশস্ত্র পন্থায় ইসলামী শাসন কায়েমের জন্য
বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। শরীয়তের বিভিন্ন বিষয়ের তাৎপর্য অনুধাবন না করা, নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি এবং মুহাক্কিক উলামায়ে কেরামের কাছ থেকে ইসলামের শিক্ষা লাভ না করার
কারণে অনেক ক্ষেত্রে এরূপ চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তার লাভ করছে। আজকের সম্মেলন এসব স্বল্প জ্ঞানী লোকদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণের ব্যাপারে খুবই সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ প্রদান করছে। এ সম্মেলন শারী‘আহর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সঠিক ও নির্ভুল জ্ঞান
লাভের জন্য নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি এবং মুহাক্কিক্ব আলিমগণের শরণাপন্ন হওয়ার প্রতি সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি পরামর্শ প্রদান করছে।
১০. বোমাবাজি ও সন্ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগে কোন ব্যক্তির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার পূর্বে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ যথার্থ ও আইনানুগ পন্থায় যাচাই-বাছাই
এবং সুষ্ঠু তদন্ত
করা অপরিহার্য। যেন ন্যায়
বিচার দলিত-মথিত
এবং মানবাধিকার লংঘিত না হয়।
১১. বোমাবাজি, সন্ত্রাস বা বিশৃঙ্খলামূলক কোন কাজে
জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির দোষ প্রমাণিত না হওয়া
পর্যন্ত তিনি নির্দোষ বলে গণ্য। অতএব, সুষ্ঠু তদন্তে দোষী
সাব্যস্ত হওয়ার পূর্বে এরূপ কোন ব্যক্তিকে সন্ত্রাসী বা জঙ্গী
হিসেবে চিহ্নিত করা বা তার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে তার সম্মান হানি করা কোন ক্রমেই জায়েয
নেই। অতএব এরুপ
কর্মকান্ড থেকে বিরত
থাকার জন্য আজকের
সম্মেলন যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
১২. কোন ধরনের
সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া
হয়রানিমূলকভাবে কোন নাগরিককে গ্রেফতার করা বা গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে
নির্যাতন চালানো জায়েয
নেই। নির্বিচারে ধরপাকড় করে সমাজে ত্রাস
ও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে নাগরিক জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলা কোনক্রমেই কাম্য নয়।
১৩. যে সব নাগরিক ভ্রান্ত বিশ্বাসে সন্ত্রাস ও বোমাবাজির মতো আত্মঘাতী পথ বেছে নিয়েছে তাদের
চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসে সংশোধনী আনার
জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তারা এসব অপকর্ম ছেড়ে
সঠিক রাস্তায় ফিরে
আসতে চাইলে শান্তির স্বার্থে আলোচনা ও সাধারণ ক্ষমার দরজা
খোলা রাখতে সরকারের প্রতি এ সম্মেলন আহ্বান জানাচ্ছে।
১৪. বোমাবাজি, সন্ত্রাস ও আত্মঘাতী হামলা একটি
জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন সম্মিলিত ও ঐক্যবদ্ধ আন্তরিক প্রয়াস। পারস্পরিক দোষারোপ না করে দলমত
পেশা নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিক আন্তরিকভাবে এ সমস্যা সমাধানে প্রচেষ্টা চালালে এর সমাধান সম্ভব
বলে আজকের সম্মেলন মনে করে। অতএব, সকল রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, ইলেক্ট্রোনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দসহ সর্বস্তরের জনগণকে এ সংকট
নিরসনে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসার জন্য এ সম্মেলন উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে।
১৫. ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা করা তথা নিজেকে নিজে হত্যা
করা কবীরা গুনাহ। কোন ব্যক্তি নিজেকে হত্যা করলে তার পরিণাম জাহান্নাম। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
“আর তোমরা তোমাদর নিজেদেরকে হত্যা করো না অর্থাৎ আত্মহত্যা করো না, আল্লাহ তোমাদের উপর অতিশয়
দয়ালু।”
(সূরা নিসা, আয়াতঃ ২৯)
রাসুল
(সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ার কোন জিনিস
দ্বারা নিজেকে হত্যা
করবে, কিয়ামত দিবসে
ঐ জিনিস দ্বারা তাকে শাস্তি দেয়া
হবে।
(বুখারী ৬০৪৭, মুসলিম ১৭৬)
রাসুল (সা.)
আরো বলেছেন- “এক ব্যক্তির শরীরে প্রচণ্ড যখম বা ক্ষত
ছিল, সে ক্ষতের জালা সহ্য করতে
না পেরে আত্মহত্যা করলো। তখন আল্লাহ তায়ালা বললেন, “আমার
বান্দা তাঁর জীবন
নিয়ে আমার উপর তরান্বিত করলো। এ জন্য আমি তার জন্য বেহেশত হারাম
করলাম।” (বুখারীঃ ১৩৬৪, মুসলিমঃ ১৮০) ।
অতএব যারা বাংলাদেশে আত্মঘাতি বোমা
হামলা চালিয়ে নিজেদের জীবনকে বিসর্জন দিচ্ছে তারা ইসলামের দৃষ্টিতে বড় রকমের অপরাধী