[উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুজুর্গ ও আলেমে দ্বীন হজরত
মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)
১৯৮৭ সালের ৭ মে ইন্তেকাল করেন। হুজুরের সুবিশাল কর্মময় জীবনকে পাঠক সমাজে তুলে
ধরেছেন তাঁরই সুযোগ্য পুত্র ঢাকার কাওরান বাজারস্থ আম্বরশাহ শাহি মসজিদের ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা কারী আতাউল্লাহ]
পবিত্র কোরআনের প্রেমিক এবং এ কোরআন নিয়েই
ছিল যাঁর ভাবনা-চিন্তা ও সারা
দিনের কর্মব্যস্ততা, আর যিনি ভাবতেন কিভাবে দেশের প্রতিটি গ্রামে কোরআনের আলো পৌঁছে
দেওয়া যায়, কিভাবে শিশু-কিশোররা সহজে
কোরআনের জ্ঞান লাভ করতে পারে। এ জন্য যিনি বারবার বলতেন, ৬৮ হাজার
গ্রামে ৬৮ হাজার
মক্তব প্রতিষ্ঠার কথা, তিনি হলেন হজরত
মাওলানা হাফেজ মুহাম্মাদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)।
শিক্ষাজীবন
হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) শৈশবে
নিজ গ্রামের অদূরে
ফতেপুর প্রাইমারি স্কুল থেকে উচ্চ প্রাইমারি পাস করে চন্দ্রগঞ্জ মাদ্রাসায় এক বছর পড়াশোনা করেন। কুমিল্লার লাকসামে নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর মাদ্রাসায় আরো এক বছর পড়েন। তখন তিনি
এক পীর সাহেবের বাড়ি জায়গির থাকতেন। পীর সাহেব তাঁকে দৈনিক
এক-দেড় ঘণ্টা
আপাদমস্তক কাপড়ে ঢেকে
জিকির করাতেন। ফলে ছোটবেলা থেকেই হাফেজ্জী জিকিরে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। পীর সাহেবের বাড়িতে পড়াশোনায় সমস্যা হলে তিনি নোয়াখালীর খিলবাইছ মাদ্রাসায় ভর্তি হন।
এ সময় একদিন আবর্জনার মধ্যে কোরআন পাকের
আয়াত 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম'
লেখা এক টুকরা
কাগজ দেখে তিনি
তা তুলে এনে পরিষ্কার করে সযত্নে রেখে দেন। এই ঘটনার প্রভাবে তাঁর
মন গভীরভাবে আল্লাহ ও কোরআনের দিকে
ঝুঁকে পড়ে।
তিনি কোরআন হিফজ করার
জন্য কাউকে না বলে মাত্র দেড় টাকা সম্বল নিয়ে
ভারতের পানিপথের উদ্দেশে বেরিয়ে যান। উল্লেখ্য, সে যুগে ভারতবর্ষে পানিপথের হিফজখানাটি ছিল হিফজ ও ইলমে কিরাত শিক্ষার অদ্বিতীয় স্থান।
বহু অলৌকিক ঘটনার মধ্য
দিয়ে পানিপথে পৌঁছে
তিনি ১৯১৩ সালে
হজরত কারী আবদুস
সালাম (রহ.)-এর অধীনে হিফজ শুরু
করেন। হিফজ শেষ হওয়ার আগেই তিনি
ও তাঁর ওস্তাদ দুজনই মহামারিতে আক্রান্ত হন। এতে ওস্তাদজি হজরত কারী আবদুস সালাম
(রহ.) ইন্তেকাল করেন, কিন্তু তিনি বেঁচে যান। সুস্থ হওয়ার পর বাকি হিফজ হজরত
কারী আখলাক হুসাইন (রহ.)-এর অধীনে ১৯১৫ সালে শেষ করেন।
পানিপথ থেকে হিফজ শেষে
তিনি ১৯১৫ থেকে
১৯২২ সাল পর্যন্ত সাহারানপুর মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন
এবং সেখান থেকে
দাওরা (গ্র্যাজুয়েশন) শেষ করে ১৯২৩ সালে
দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ফুনুনাত আলিয়া
তথা ইসলামী শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরের সনদ লাভ করেন।
হাফেজ্জীর কর্মজীবন ও অবদান
পড়াশোনা শেষে তিনি তাঁর
সাথি হজরত শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) ও হজরত মাওলানা আবদুল
ওয়াহাব পীরজি হুজুর
(রহ.)-এর সহায়তায় দেশের
বিভিন্ন স্থানে দেওবন্দের নিয়মে নতুন নতুন
মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। তাঁদের প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, বাগেরহাট ও ঢাকার বড়কাটারায়, ফরিদাবাদে, লালবাগে বড় বড় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৬৫ সালে ঢাকার
কামরাঙ্গীরচরে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর একক প্রচেষ্টায় নূরিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)
প্রতিবছর রমজান মাসে
মাদ্রাসা-ই-নূরিয়ায় তাঁরই ছাত্র নাদিয়াতুল কোরআনের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবদুল
ওহাব ও নূরানি শিক্ষা পদ্ধতির প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা বেলায়েত হুসাইনের মাধ্যমে কোরআন শেখানোর প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা করতেন! তিনি তাঁদের দুজনকেই এ বিষয়ে
উৎসাহ দিতেন- তাঁরা
যেন তাঁদের অভিজ্ঞতার আলোকে কোরআন শিক্ষার পদ্ধতিকে আরো সহজ ও সুন্দর করার
লক্ষ্যে উভয় পদ্ধতিকে সমন্বিত করে আরো সহজ কিছু করার
চিন্তা-ফিকির করেন। বর্তমানে নূরানি ও নাদিয়া এ দুটি
পদ্ধতিতে শিশু-কিশোরদের কোরআন শিক্ষাদানের সুব্যবস্থা বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে
এবং সমাদৃত হয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমানে সারা দেশে
প্রচলিত মক্তব শিক্ষা ও কোরআন হিফজের বিশাল পরিধির পেছনে
রয়েছে হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর বিশেষ অবদান। বড়কাটারা মাদ্রাসা কায়েমের পর হজরত
(রহ.) পানিপথের পদ্ধতি অনুসরণে একটি আদর্শ আবাসিক হিফজখানা প্রতিষ্ঠা করলেন। রাতের
শেষ প্রহরে উঠে ছাত্ররা কোরআন পাঠ শুরু করত, ফজরের
পর শিক্ষককে সবক মুখস্থ শোনাত, সাত সবক শোনাত, তারপর
শুয়ে বিশ্রাম নিয়ে
নব উদ্যমে জোহরের আগে থেকেই আবার
পড়া শুরু করত,
আসরের পর নির্মল বিনোদন ও খেলাধুলা করে মনকে প্রফুল্ল করে আবার মাগরিবের পর থেকে পড়া শুরু হয়ে রাত ৯টা বা ১০টায়
ছুটি হতো। তখন ঢাকায় এটাই ছিল প্রথম আবাসিক আদর্শ
হিফজখানা, আর পরিচালনার শীর্ষে ছিলেন হজরত
হাফেজ্জী হুজুর (রহ.);
বর্তমানে দেশজুড়েই আবাসিক হিফজখানার এ ধারার
প্রচলন হয়। তাঁর দ্বীনি খিদমতের তুলনা
বিরল। আমি বহুবার তাঁর মোবারক জবান
থেকে শুনেছি, তিনি
বলতেন, "আমরা তিনজন (আমি,
মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, সদর সাহেব
হুজুর ও পীরজি
হুজুর) যখন ঢাকায়
এসে বড়কাটারা মাদ্রাসা শুরু
করলাম, তখন ঢাকার
মসজিদগুলোতে সহি-শুদ্ধভাবে কোরআন তিলাওয়াতে সক্ষম ইমামের সংখ্যা ছিল খুবই সামান্য। এখন আলহামদুলিল্লাহ পানিপথের পদ্ধতিতে কোরআনের ওপর ধারাবাহিক মেহনতের ফলে শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে সহি-শুদ্ধভাবে কোরআন পাঠকের সংখ্যা কল্পনাতীত।" এখন তো দুনিয়ার সব মানুষই দেখছে, বাংলাদেশের হাফেজগণ তিলাওয়াতুল কোরআনের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রথম
পুরস্কার পেতে শুরু
করেছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)
নিজেকে কোরআন ও সুন্নাতে রাসুলের বাস্তব নমুনারূপে গড়ে তোলার
সাধনায় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিলে তিলে
কাজে লাগিয়েছিলেন।
হজরত আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর খিলাফত লাভ
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)
ছিলেন চতুর্দশ শতাব্দীর মহান সংস্কারক হাকিমুল উম্মত
হজরত মাওলানা শাহ আশরাফ আলী থানভী
(রহ.)-এর বিশেষ খলিফাদের অন্যতম। তাঁর আধ্যাত্মিকতার পরিধি ছিল বিশাল।
হজরত মাওলানা শাহ আশরাফ
আলী থানভী (রহ.)-এর সুদীর্ঘ সাহচর্যের বরকতে শরিয়তের জ্ঞানের পাশাপাশি তাজকিয়া, সুলুক
ও মা'রেফাতে ইলাহির চূড়ায় আরোহণ
করেছিলেন তিনি। ফলে ইসলামী শরিয়তের জ্ঞান
তাঁর স্বভাব ও মজ্জার সঙ্গে মিশে
গিয়েছিল। তিনি তাঁর
জীবনের প্রথম হজ আদায়ের জন্য মক্কা
মুয়াজ্জমায় যান এবং ফেরার পথে স্বীয়
শাইখ হজরত আশরাফ
আলী থানভী (রহ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য যান। এ সময় তিনি কয়েক
দিন সেখানে থাকেন। দেশের উদ্দেশে রওনা
হওয়ার প্রাক্কালে বিদায় নিতে গেলে হজরত
থানভী (রহ.) অত্যন্ত স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বললেন,
"বাড়ি পৌঁছে কুশল
সংবাদ জানিয়ে পত্র
দেবে।' সে মতে হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) বাড়ি পৌঁছেই স্বীয় শাইখকে সহি-সালামতে বাড়ি পৌঁছার খবর জানিয়ে চিঠি
লেখেন। পত্রোত্তরে হাকিমুল উম্মত
হজরত আশরাফ আলী থানভী (রহ.) তাঁর
খলিফা হিসেবে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-কে নিযুক্ত করেন।
বিদেশ সফর
১৯৮২ সালে হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ইরান-ইরাক সফর করেন
এবং ইমাম খোমেনি ও মরহুম সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ইরান-ইরাক
যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা করেন।
ইন্তেকাল
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)
১৯৮৭ সালের ৭ মে ইন্তেকাল করেন। হাইকোর্টসংলগ্ন জাতীয়
ঈদগাহ ময়দানে তাঁর
জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ইমামতি করন হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র
কারী শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফ (বড় ভাই);
জানাজায় দেশের বিভিন্ন স্থান ও অঞ্চল
থেকে হাজার হাজার
শোকার্ত জনতা অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন
জাতি-ধর্ম-বর্ণ
নির্বিশেষে সমাজের সব মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র। যা এ যুগে খুবই
বিরল।
ঢাকার সাবেক মেয়র মরহুম
মোহাম্মদ হানিফ উদ্যোগী হয়ে নগর ভবন সংলগ্ন ফিনিক্স রোডের
নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করেন
'মওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) রোড'।
সৈজন্যে ঃ দৈনিক কালের কন্ঠ, ৯ই মে ২০১৪, শুক্রবার।