ঢাকার জার্মান সাংস্কৃতিক
কেন্দ্রের আজকের এই অনুষ্ঠানের সভাপতি, আলোচকবৃন্দ ও উপস্থিত সুধী মন্ডলী, আচ্ছালামু আলাইকুম।
স্তাপত্যকলা ও ধর্মের উপর
জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে ৪ দিন ব্যাপী যে প্রদর্শনী ও অনুষ্ঠান চলছে আজকে তার
দ্বিতীয় দিন। আমাকে এই অনুষ্ঠানে “দি কমন প্যাট্রিমনি অব ম্যানকাইন্ড এন্ড দি বিউটি অব ইউনিটি
ইন ডাইভারসিটি” শীর্ষক আলোচনায় আমন্ত্রণ
জানানোর জন্য আমি গোথে ইন্সটিটুটের পরিচালক মি. টরস্টেন ওরটেলকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ
জানাচ্ছি।
আমি রাজনৈতিক ইসলাম ও
কওমী মাদ্রাসা ব্যাবস্থার পক্ষের একজন একটিভিস্ট কর্মী। নাইন-ইলেভেন উত্তর বিশ্বে
যখন রাজনৈতিক ইসলাম ও কওমী মাদ্রাসা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনা চলছে তখন আমাকে
এ অনুষ্ঠানে কথা বলার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আমি
গোথে ইন্সটিটুটের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
আমি মনে করি, ভিন্ন মত সত্বেও আমাকে
আমন্ত্রণ জানিয়ে গোথে ইন্সটিটুট বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের সৌন্দর্য প্রকাশে তাঁদের
আন্তরিকতার প্রমাণ রেখেছেন।
আমি খেলাফত আন্দোলনের
কর্মী। আমাদের প্রয়াত নেতা হযরত মওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ:)
প্রায়ই বলতেন, “মুসলমানরা আমার ধর্মীয়
ভাই, আর অমুসলমানরা আমার খান্দানী ভাই, কারণ সকল মানুষই আদি পিতা-মাতা হযরত আদম ও হাওয়া (আ:)এরই
বংশধর।”
আল্লাহ বলেন: “হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ (আদম আ:) ও একজন নারী
(হাওয়া আ:) থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও বিভিন্ন গোত্র
করেছি যেন তোমরা একে অন্যকে চিনতে পার। তোমাদের মধ্যে যে অধিক মোত্তাকী
(আল্লাহওয়ালা) সে আল্লাহর নিকট অধিক সম্ভ্রান্ত; আল্লাহ সর্ব্বজ্ঞ ও সজাগ।” (ক্বোরআন ৪৯:১৩)।
হযরত মুহাম্মদ (দ:) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেন: “সকল মানুষই আদম (আ:) ও
হাওয়া (আ:)-এর সন্তান। অনারবের
চেয়ে আরব উত্তম নয়, আরবের চেয়ে অনারব উত্তম
নয়। কালোর চেয়ে সাদা উত্তম নয়, সাদার চেয়ে কালো
উত্তম নয়। উত্তম সেই যে বেশী ভাল কাজ করে এবং বেশী মোত্তাকী (আল্লাহওয়ালা)।”
আজকে দুনিয়ায় ইসলাম ও মুসলমান কে নিয়ে
যে দ্বন্দ্ব-সংঘত সৃষ্টি
হয়েছে তা কতটা
ধর্ম-সাস্কৃতি-নৃতাত্বিক কারণে, কতটা
পর-ধন-লিপ্সার কারণে, কতটা আধিপত্য বিস্তারের
অভিপ্সার কারণে, কতটা আপন আপন জেদ ও
অহংকারের কারণে, কতটা ভুল ব্যাখ্যার কারণে,
কতটা অজ্ঞতার কারণে, কতটা অন্ধত্বের কারণে, কতটা পরস্পরকে ভুল বুঝার কারণে - তা
সকল পক্ষকেই ঠান্ডা মাথায় খতিয়ে দেখতে হবে।
অনেক সময়ই দেখা যায, এক পক্ষের অন্যায়
পদক্ষেপ অন্য পক্ষকেও অন্যায় পথ অবলম্বনে উস্কানী দেয়।
যাঁরা ভাল অবস্থানে আছেন
তাঁদের দ্বায়িত্ব যারা খারাব অবস্থানে আছেন তাঁদের চাইতে বেশী। শক্তিমান ও প্রিভিলেজডরা যদি তাঁদের ক্ষমতা ও
সুযোগ সুবিধা অন্যায় পথে ব্যাবহার করেন,
তাহলে
দুদিন আগে হোক বা পরে হোক তাঁরা তাঁদের ক্ষমতা ও প্রিভিলেজ হারাবেন।
মানুষ তার মেধা দিয়ে তার
আয়ত্বাধীন বিষয়ের চুল-চেরা বিচার বিশ্লেষণ করতে পারে। যেমন স্বর্ণকার পারে তার
তুলাদন্ড দিয়ে সোনা-রূপার ক্ষুদ্রাংশও পরিমাপ করতে। কিন্তু স্বর্ণকার যদি তার
তুলাদন্ড দিয়ে হিমালয় পর্বত মাপতে চায় তবে তা পারবে না। এর অর্থ এই নয় যে
স্বর্ণকারের তুলাদন্ডে কোন ত্র“টি আছে। অনুরূপভাবে মানুষের মেধাশক্তি সঠিক ও নির্ভুল
হওয়া সত্বেও আল্লাহর উৎস কি তা মেধা দিয়ে জানা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, যেমন স্বর্ণকারের তুলাদন্ড দিয়ে হিমালয় পর্বত মাপা যায়
না। আমি স্রষ্টাকে বিশ্বাস করি, স্রষ্টার প্রিয়ভাজনদের সাহচর্য অবলম্বন করি, স্রষ্টার ইচ্ছার অনুকুলে চলার চেষ্টা করি।
আমরা চেষ্টা করছি হিন্দু,
মুসলমান, ইহুদী, খ্রীষ্টান সকল
সম্প্রদায়ের মাঝে যাতে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও আস্থা সৃষ্টি হয়। এজন্য বাংলাদেশ ইন্টার-ফেইথ কাউন্সিল ফর পিস
এন্ড জাস্টিস (বিকপেজ)এর প্রতিষ্ঠাতা সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শ্রী সজ্ঞীব
চৌধুরীকে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হয়েছে; আমেরিকান জিউইশ কমিটির
ইন্টার-ফেইথ-স্ট্রেংথ-এর সাথে
খেলাফত আন্দোলন ডায়ালগ অব্যাহত রেখেছে। ভাল-মন্দ এবং পাপ-পূণ্যের নীতি আমাদের সকল
সম্প্রদায়ের প্রায় একই। প্রায় সকলের ধর্মই
আস্তিক্যবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আজকাল
সকল সম্প্রদায়েরই নেতৃস্থানীয়দের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ইউরোপীয়
সভ্যতার বস্তুবাদ ও নাস্তিক্যবাদ দ্বারা প্রভাবিত। ফলে মানব জাতির ঐক্যের ভিত দুর্বল হয়ে
গেছে। আমরা উদ্যোগ গ্রহন করেছি যাতে,
সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও ভরসার
ভিত্তিতে, ইনসাফ ও সৎকর্মের
মূল্যায়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে সকল সম্প্রদায়ের ্ঈশ্বরপ্রেমিক মানুষ সমাজের সামনের
কাতারে এগিয়ে যেতে পারেন।
যখন কিছুই ছিলনা তখনো
আল্লাহ ছিলেন। যা কিছুই সৃষ্টজগতে আছে
তার উৎস আল্লাহ তায়ালা। সৃষ্ট জগতে ঐক্য,
অনৈক্য, বৈপরিত্য, পার্থক্য,
দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ, সন্ধী যত কিছুই
দৃশ্যমান হোক না কেন - সব কিছুই এক আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। আমরা বুঝি বা না বুঝি, চাই বা না চাই - সৃষ্ট জগতে আল্লাহ-কেন্দ্রীক ঐক্য
বিদ্যমান। তাই লক্ষ্য করলেই আমরা সৃষ্ট
জগতে প্রাকৃতিক বৈচিত্রের মাঝে এক গভীর অপরূপ ঐক্য দেখতে পাই। মানুষকে আল্লাহতায়ালা ইচ্ছা শক্তি, বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতর অবয়ব দিয়েছেন। মানুষ তার এই স্বাধীণতা ও উচ্চতর বৈশিষ্টকে
আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে তাঁর পছন্দ অনুযায়ী পরিচালিত করলে আমাদের
পার্থক্য ও বৈচিত্র আমাদের সফলতা, আনন্দ ও
সৌন্দর্য্যে পরিণত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে
ক্ষমা করুন এবং আমাদের নানান মতপার্থক্য সত্বেও পারস্পরের শুভাকাংখী করুন। আমীন।
ওয়াচ্ছালাম।
- কাজী আজীজুল হক (আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন)
৩রা এপ্রিল ২০০৭