সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হাটহাজারী মাদরাসায় গতকাল বিকালে এক
সংবাদ সম্মেলন করেছেন নেতারা। জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামের আমিরের
পক্ষে কেন্দ্রীয় সাহিত্য সম্পাদক মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী সাংবাদিকদের ব্রিফিং
করেন।
হাটহাজারী
৭ই মে ২০১৩
লিখিত বক্তব্যে
মাওলানা আশরাফ আলী, আমিরের পক্ষে:
আমরা এমন এক সময়
আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি, যখন এদেশের আলেম
সমাজ ইতিহাসের এক নিষ্ঠুরতম নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার। এমন নিষ্ঠুরতম পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড
বাংলাদেশে এর আগে আর ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। এদেশের নিরীহ আলেম ও ধর্মপ্রাণ
মানুষের রক্তের দাগ এখনও রাজপথে লেগে আছে, লাশ পড়ে আছে
হাসপাতালে মর্গে, অজানা স্থানে। মহান আল্লাহ ও তাঁর
রাসুলের ভালোবাসার টানে ঘর থেকে বের হওয়া হাজার হাজার নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষ এখনও
ঘরে ফেরেনি। তারা কোথায়, কি অবস্থায় আছেন, জীবিত আছেন কি না আমরা কিছুই জানতে পারছি না। এক চরম
বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দেশ অতিক্রম করছে। এমন ভয়াবহ ভীবত্সতা
যুদ্ধবাস্থাকেও হার মানিয়েছে।
রাজধানীর
মতিঝিলের শাপলা চত্বর এলাকায় ৫ মে রাতে ঘুমন্ত, জিকিররত নিরীহ নিরস্ত্র লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ আলেম-ওলামার ওপর
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের মুসলমান নামধারী সরকার রাতের আঁধারে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও দলীয়
সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে নৃশংস নির্মম, বর্বর অমানবিক
হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। সেখানে কত লোক শহীদ হয়েছেন সেই পরিসংখ্যান যাতে না পাওয়া যায়, সেজন্য সঙ্গে সঙ্গেই লাশ গুম করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে, ট্রাকভর্তি করে
লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই লাশের সংখ্যা আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার পর্যন্ত হতে
পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। সেখান থেকে আলামত দ্রুত সরিয়ে নেয়া হয়েছে। হাজার
হাজার মানুষকে আহত করা হয়েছে। আলেমদের বেইজ্জতি করে ঢাকা থেকে বের হতে বাধ্য করা
হয়েছে। আমাদের রাজধানীতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়নি। হেফাজতে
ইসলামের মহাসচিব আল্লামা বাবুনগরীকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হচ্ছে। অন্য শত শত
আলেমকে গ্রেফতার করার জন্য মিথ্যা মামলা করা হচ্ছে।
তার আগে ৫ মে দুপুর থেকেও গুলিস্তান, পল্টন, বায়তুল মোকাররম, বিজয়নগর, দৈনিক বাংলার
মোড় এলাকায় বিনা উসকানিতে পুলিশ ও সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা শাপলা চত্বরগামী
মিছিলের ওপর হামলা ও সরাসরি খুঁজে খুঁজে গুলিবর্ষণ করে অসংখ্য লোককে হত্যা ও আহত
করেছে। যা টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের মানুষ সরাসরি দেখেছে। তারা সেখানে
ব্যাপক ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। পরে তা
হেফাজতে ইসলামের ওপর দায় চাপানো অপচেষ্টা চালায়।
আমরা
পরিষ্কারভাবে বলতে চাই,
যার সামান্যতম ঈমান আছে, পরকালে বিশ্বাস আছে, আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করার ভয় আছে, বিবেক ও মানবিক বোধ আছে, দেশের মানুষের
প্রতি দায়িত্ববোধ আছে,
গণতন্ত্রের প্রতি
শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস আছে—আলেমদের ওপর এমন নিষ্ঠুর নির্মম
হত্যাকাণ্ডের মতো কাজ সে করতে পারে না।
আমরা ১৩ দফা
দাবি সরকারের কাছে পেশ করে সরকারকে সময় দিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার মুসলমানদের ঈমান
আকীদা সম্পর্কিত এ ১৩ দফা বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোনো আশ্বাস পর্যন্ত দেয়নি। বরং
তাদের অনেকে এ ১৩ দফা বাস্তবায়ন করাকে মধ্যযুগে ফিরে যাওয়া, সংবিধানবিরোধী ইত্যাদি আখ্যায়িত করে উপহাস পর্যন্ত
করেছে। আমরা ১৩ দফার ব্যাখ্যা দিয়েছি। আইনি ব্যাখ্যাও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে
পাঠিয়েছি। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী আমাদের দাবির দফাভিত্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে সবগুলো
দাবি কৌশলে প্রত্যাখ্যান করেন। আমরা পূর্বঘোষণা অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি
পালনের ঘোষণা দিয়ে দাবি আদায়ে কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার ব্যাপারে সরকারকে হুশিয়ার
করেছি। সরকার আমাদের দাবির প্রতি কর্ণপাত করেনি।
সমাবেশ চলাকালীন
সরকারি দলের সন্ত্রাসী কখনও স্বরূপে, কখনও হেফাজত
কর্মী সেজে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। তাদের হামলায় রাস্তায় সাধারণ
মুসল্লিদের লাশ পড়ে থাকে। উদ্ধার করতে যাওয়ার জন্য সাহস করছিল না কেউ। ফলে
স্বাভাবিক কারণে সমাবেশে অংশ নেয়া লাখ লাখ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
কিন্তু আমাদের কোনো কথায় কর্ণপাত না করে
নজিরবিহীনভাবে আগ্রাসী তত্পরতা চালানোয় উদ্ভূত ঘটনা আমাদের কাছে অত্যন্ত পরিকল্পিত
ও উসকানিমূলক মনে হচ্ছে। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, আমাদের শাপলা চত্বরে সমাবেশের অনুমতি দেয়া, তারপর অন্যপ্রান্তে হামলা করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে, সরকারি দলের নেতার পক্ষ থেকে দুই দফায় সংবাদ সম্মেলন
করে আমাদের সরে যাওয়ার আলটিমেটাম দেয়া এবং রাতে আমাদের সমাবেশের ওপর হত্যাকাণ্ড
চালানোর পুরো ঘটনাই সরকারের পূর্বপরিকল্পিত। সরকার কী উদ্দেশ্যে আমাদের মতো
শান্তিপ্রিয় অরাজনৈতিক মানুষগুলোকে মজলুমে পরিণত করল আমরা জানি না।
এদেশের আলেম
সমাজ ধর্মপ্রাণ মানুষ শান্তিপ্রিয়। তারা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ঈমানী দাবি আদায়ে
বদ্ধপরিকর। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি এদেশের ১৬ কোটি তৌহিদি জনতার দাবি। ৬
এপ্রিলে লংমার্চ, ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে লাখ লাখ
লোকের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এটা পরিষ্কার হয়েছে, এই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আলেমসমাজ ঘরে ফিরে যাবে
না। সরকার আমাদের আর বের হতে না দেয়ার হুমকি দিয়েছে। কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে
জনগণের দাবি-দাওয়ার আন্দোলনকারীদের এভাবে হুমকি দেয়ার নজির নেই।
সরকার হেফাজতের খবর প্রচার করার অপরাধে সর্বশেষ
জনপ্রিয় দুটি টেলিভিশন চ্যানেলকে বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যান্য গণমাধ্যম আমাদের
বিরুদ্ধে উসকানিমূলক খবর প্রচার করছে।
আমরা পরিষ্কার
করে বলতে চাই, সরকার তার মনোভাব ও অবস্থান পরিবর্তন না
করলে তাদের কী পরিণতি হবে আমরা জানি না। কারণ দেশের অধিকাংশ মানুষকে এভাবে দমন করে
জোর করে কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারেনি, এই সরকারও পারবে
না। আলেম সমাজ রাজনীতি করে না। কাউকে ক্ষমতায় বসানো বা নামানোর জন্য আলেমদের
আন্দোলন নয়।
আমরা সরকারকে সর্বশেষ সুযোগ দিয়ে বলতে চাই, আমাদের হাজার হাজার লোককে শহীদ করেছেন। হাজার হাজার
লোককে আহত করেছেন। আমাদের হত্যা করে, উল্টো আমাদের
ওপর মামলা দেয়ার চেষ্টা করছে। এ পথ পরিহার করুন। দ্রুত আলেম সমাজের কাছে ক্ষমা চান, নিহত আহতদের পরিসংখ্যান দিয়ে তাদের দাফন কাফনের
ব্যবস্থা করুন। আহতদের চিকিত্সার ব্যবস্থা করুন। মামলা প্রত্যাহার করুন। হেফাজতে
ইসলাম মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
আমরা সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি, অবিলম্বে হেফাজত
মহাসচিবসহ সব নেতাকর্মী নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করুন।
হেফাজতের বিরুদ্ধে সব অপপ্রচার বন্ধ করুন। রাস্তার পাশের শত শত গরিব মানুষের
দোকানে এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকে তারা আগুন লাগিয়ে ও লুটপাট করে
হেফাজতের ওপর দোষ চাপায়। যা বিভিন্ন মিডিয়ায় সচিত্র প্রকাশিত হয়েছে। আমরা এ অন্যায়
অপপ্রচারের তীব্র নিন্দা জানাই।
এ হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি তদন্তে বিচার বিভাগীয়
তদন্ত কমিটি গঠন করে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করুন। দ্রুত আমাদের ১৩ দফা দাবি
মেনে নিন। না হয় তৌহিদি জনতার মধ্যে যে তীব্র ক্ষোভের দানা বেধেছে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি দিয়ে
বেশিদিন দমিয়ে রাখতে পারবেন না। সারাদেশে এর ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটবে, ইনশাআল্লাহ।
=0=
সংবাদ সম্মেলনে
আরও উপস্থিত ছিলেন হেফাজতের সিনিয়র নায়েবে আমির আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ
বাবুনগরী, আল্লামা হাফেজ
মুহাম্মদ শামসুল আলম, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা লোকমান হাকিম,
এমএ তাহের, কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা
সালাহ উদ্দীন নানুপুরী, মাওলানা হাফেজ মুহাম্মদ তৈয়্যব,
মাওলানা আবু তাহের আরবী, মাওলানা
হাবীবুল্লাহ, মাওলানা নূরুল ইসলাম, মাওলানা মাহমুদুল হাসান ফতেপুরী, মাওলানা
নাছির উদ্দিন মুনির, মাওলানা জাহাঙ্গীর মেহেদী, মাওলানা ইয়াসীন, মাওলানা আলমগীর, মাওলানা এমরান প্রমুখ।