Powered By Blogger

Wednesday, May 15, 2013

হযরত আল্লামা আহমদ শফী (দাঃবাঃ)-কে উপদেষ্টা করে ইসলামি দলগুলোর নেতৃবৃন্দ-এর যৌথ বিবৃতি


16 May, 2013 :  ইসলামি দলগুলোর নেতৃবৃন্দ গতকাল এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন:-

 

-হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইতোমধ্যেই দেশের মসজিদে মসজিদে কুনুতে নাজেলা চালু হয়েছে। জালিম শাহির জুলুম নির্যাতন ইসলামের দুশমনদের ইসলাম নির্মূলনীতি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত দেশের সব মসজিদে কুনুতে নাজেলা অব্যাহত থাকবে।

 

-নরপশুরা ৫ মে পবিত্র কুরআন মজিদে আগুন দিয়ে মুসলিম উম্মাহর কলিজায় আগুন ধরিয়েছে- ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

-বিগত ৫ মে হেফাজতের নেতাকর্মীদের ওপর হামলায় পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

 

-লাশ কোথায় গুম করা হলো তার সঠিক জবাব দিতে হবে। আলেম-উলামাদের লাশের খোঁজে যখন তাদের আত্মীয়স্বজনরা বিভিন্ন হাসপাতালে ও থানায় খোঁজখবর নিতে যাচ্ছেন তখন তাদেরও গণগ্রেফতার করা হচ্ছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে নির্লজ্জভাবে বলা হচ্ছে ৫ই মে’র গণহত্যার শিকার যারা তাদের আত্মীয়স্বজন কোথায়?

 

-সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন,

  কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী এবং নারীর প্রতি অবমাননাকর নারীনীতি সংশোধন,

  ধর্মহীন জাতীয় শিক্ষানীতি সংশোধন,

  ইসলাম ও মহানবী সা:কে অবমাননাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি,

  মাদরাসা বন্ধের চক্রান্ত বন্ধ

সর্বোপরি দেশ ধর্মহীন ও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্ত বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলতে থাকবে।

 

বিবৃতিতে  স্বাক্ষর করেনঃ-

 

ইসলামি দলগুলোর উপদেষ্টা আল্লামা আহমদ শফী,

 

রাবেতা আলম আল ইসলামীর স্থায়ী সদস্য ও সম্মিলিত উলামা মাশায়েখ পরিষদের সভাপতি মাওলানা মুহিউদ্দীন খান,

 

বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রধান আমিরে শরিয়ত  ও ইসলামি দলগুলোর আহ্বায়ক মাওলানা শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফ,

 

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি শাইখ মাওলানা আবদুল মোমিন,

 

খেলাফত মজলিসের আমির ও সম্মিলিত উলামা মাশায়েখ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্য মাওলানা মোহাম্মাদ ইসহাক,

 

ইসলামী ঐক্যজোটের সভাপতি ও সম্মিলিত উলামা মাশায়েখ পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী,

 

সম্মিলিত উলামা মাশায়েখ পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্য মাওলানা যাইনুল আবেদীন,

 

ইসলামি দলগুলোর সদস্যসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা জাফরুল্লাহ খান,

 

সম্মিলিত উলামা মাশায়েখ পরিষদের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা মহিউদ্দীন রব্বানী,

 

সম্মিলিত উলামা মাশায়েখ যুগ্ম-মহাসচিব ড. মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানী,

 

ফরায়েজি আন্দোলনের আমির মাওলানা আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ হাসান, সম্মিলিত উলামা মাশায়েখ পরিষদের ঢাকা মহানগরী সভাপতি মাওলানা আহমাদ আলী কাসেমী,

 

মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা লুৎফর রহমান,

 

মিরসরাইয়ের পীর সাহেব মাওলানা আ: মোমেন নাছেরী,

 

হক্কানী পীর মাশায়েখ পরিষদের সভাপতি শাহতলীর পীর মাওলানা আবুল বশর ও মহাসচিব শর্ষিনার পীর মাওলানা শাহ আরিফ বিলাহ সিদ্দিকী,

 

টেকেরহাটের পীর সাহেব মাওলানা কামরুল ইসলাম সাঈদ আনসারী,

 

জাতীয় ফতোয়া বোর্ড সভাপতি প্রফেসর ড. মাওলানা ইহইয়ার রহমান প্রমুখ।

 

বিজ্ঞপ্তি ।

কওমী মাদ্রাসা নিয়ে বিতর্ক : ব্রিটিশদের প্রেতাত্মার আছর থেকে এ জাতি কবে মুক্ত হবে জানি না -সঞ্জী ব চৌ ধু রী



কওমী মাদ্রাসা নিয়ে বিতর্ক :  

ব্রিটিশদের প্রেতাত্মার আছর থেকে এ জাতি কবে মুক্ত হবে জানি না  

-সঞ্জী চৌ ধু রী    

আমাদের দেশে কওমী মাদ্রাসা নিয়ে নাক সটিকানো নতুন নয়  নতুন যা, তা হচ্ছে কওমী মাদ্রাসার বিরোধিতা ইদানীং প্রচন্ড তীব্রতা লাভ করছে  কওমী মাদ্রাসাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক  কওমী মাদ্রাসাগুলো ছাত্রদের কূপমন্ডুক ধর্মান্ধ বানিয়ে ফেলে, দেশে সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারের পেছনে রয়েছে কওমী মাদ্রাসা, কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা সমাজের বোঝা, ব্যাঙ্গের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কওমী মাদ্রাসাগুলো সমাজকে পেছনের দিকে টানছেএসব অভিযোগের সাথে যুক্ত হয়েছে জংগী কানেকশনের অভিযোগ

অভিযোগকারীদের মতে, কওমী মাদ্রাসাগুলো জংগী তৈরীর কারখানায় পরিণত হয়েছে জংগীপনার সাথে রয়েছে কওমী মাদ্রাসাগুলোর ঘনিস্ট সংযোগ একাত্তরে কওমী মাদ্রাসাগুলো ছিল রাজাকারদের ঘাটি এখন হয়েছে জংগীদের ঘাটি  

এসব  অভিযোগের প্রেক্ষাপটে অভিযোগকারীদের দাবী, হয় মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করে দেয়া হোক, বা নিদেন পক্ষে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যাবস্থার খোল-নলচে পাল্টানো হোক   মিডিয়ায় অভিযোগকারীদের প্রায় নিয়মিত তর্জন-গর্জন দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না তারা জোরালো প্রচার চালিয়ে পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে  

অভিযোগগুলো গুরুতর এতসব সত্য হলে বৃটিশরা যেমন সিপাহী বিদ্রোহের পর তৎকালীন ভারতবর্ষের হাজার হাজার মাদ্রাসা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল, বাংলাদেশেও তেমন কিছু একটা করতে হয় 

তার আগে কওমী  মাদ্রাসাগুলোর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ঠান্ডা মাথায় একটু খতিয়ে দেখলে মন্দ হয় না  কওমী মাদ্রাসাগুলোতে মূলত ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হয়    ধর্মচর্চা তথা ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান গ্রহন যদি কূপমন্ডুকতা হয় তাহলে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক ছাত্ররা কূপমন্ডুক কিন্তু জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন জানাচ্ছে, সারা দুনিয়ায় মানুষের মধ্যে ধর্মচর্চা বাড়ছে এর অর্থ হচ্ছে বর্তমান দুনিয়ায় গরিষ্ঠসংখক মানুষ কূপমন্ডুক হতে চাইছে  তাহলে তো কওমী মাদ্রাসাগুলো মানবজাতির সার্বিক মনমানসিকতার মূলধারাতেই আছে !  এতে দোষ হলো কোথায় ?

অতি অবশ্যই কওমী মাদ্রাসা হচ্ছে ফর দি মুসলিম, অব দি মুসলিম, বাই দি মুসলিম  ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোন কোন মাদ্রাসায় অমুসলিম ছাত্ররা প্রাথমিক শিক্ষা নেয়ার জন্য ভর্তি হলেও কথাটা সত্য কিন্তু ধর্মশিক্ষা আর ধর্মান্ধ বানানো তো এক কথা নয়  বিশেষ করে দুর্গাপুজার প্রাক্কালে বিভিন্ন স্থানে প্রতীমা ভাংচুরের যেসব ঘটনা ঘটে সে সবে কওমী মাদ্রাসার ছাত্র জড়িত নাকি আধুণিকস্কুল কলেজে পড়ুয়া ক্লিনসেভড  গুন্ডারা জড়িত থাকে তার খোঁজখবর করলে মাদ্রাসার ছাত্ররা কতটা ধর্মান্ধ তা বেরিয়ে আসবে অভিযোগকারীরা কিন্তু তথ্য আমাদের জানান না অনুরূপভাবে সাম্প্রদায়িকতার কু সিত খেলা গোটা উপমহাদেশে ইংরেজী শিক্ষিতআধুণিকলোকেরা শুরু করেছে এবং তারা নিজেদের স্বার্থে নানা কৌশলে এখনো খেলা খেলে যাচ্ছে  ইতিহাস সাক্ষী, ভারতীয় উপমহাদেশে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য মুসলমানদের আগমনের সময় থেকে বৃটিশ রাজত্ব কায়েমের আগে পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বছরে অঞ্চলে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু একটাও সাম্প্রদায়িক দাংগা হয়নি অঞ্চলের সব ধর্মের মানুষ তখন এতটাইকূপমন্ডুকছিল যে সাম্প্রদায়িক দাংগা কাকে বলে তা তার বুঝতই না অথচ সে সময়ে মুসলমানদের শিক্ষার  একমাত্র উপায় ছিল মাদ্রাসা ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিক হয়ে অঞ্চলের মানুষ বুঝতে শিখেছে যে, সাম্প্রদায়িক দাংগায় ধর্মের ইজ্জত বাড়ে, সে সঙ্গে অন্যান্য লাভেরও সম্ভাবনা থাকে

কওমী মাদ্রাসা নিয়ে কথা বলার সময় আমরা ভুলে যাই যে, এদেশে কয়েক ধরণের মাদ্রাসা আছে এগুলোকে মোটা দাগে দুভাগ করা হলেও তাতে চিত্রটা পরিষ্কার হয় না বৃটিশরা তাদের ক্ষমতা পোক্ত করার স্বার্থে সিপাহী বিদ্রোহের পর কলকাতায় আলীয়া মাদ্রাসা স্থাপন করে কালীন ভারতের বিভিন্ন শহরে সরকারীভাবে আলীয়া মাদ্রাসা গড়ে উঠতে থাকে বাংলাদেশ স্বাধীণ হওয়ার পর আমাদের ভাগেও বেশ কয়েকটি আলীয়া মাদ্রাসা পড়েছে এগুলো সরকারীভাবে পরিচালিত হয় ১৮৬৬ সালে ভারতের দেওবন্দে দারুল উলুম প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীণতা প্রত্যাশী আলেমদের উদ্যোগে  দারুল উলুমের বিকাশের মধ্য দিয়ে নতুন করে উপমহাদেশে কওমী মাদ্রাসা যুগের সূচনা ঘটে দেওবন্দের প্রেরণায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেকগুলো (বর্তমান বাংলাদেশ সহ) কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় এসব বনেদি মাদ্রাসাই আমাদের দেশে কওমী মাদ্রাসার স্টান্ডার্ড

এর পাশা পাশি বিশেষ করে বাংলাদেশ হওয়ার পর আসলেইব্যাংগের ছাতার মতোবেশ কিছু মাদ্রাসা গজিয়েছে  এগুলো দুধরনের  স্বাধীণতার পর আমাদের দেশে একটা নব্য ধণিক শ্রেণি গড়ে উঠেছে তাদের ধনাঢ্য হওয়ার পন্থা নিয়ে আমি বিতর্কে যেতে চাইনা নব্য ধণিদের মাঝে যারা মুসলমান তাদের অনেকে নিজ গ্রামে অন্তত একটা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে আভিজাত্য প্রমাণে উৎসুক হয়ে ওঠেন  তার কিন্তু মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেই খালাস এসব মাদ্রাসা চলল কী চলল না তা নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যাথা নেই এমনকি তারা নিজেদের সন্তানকেও এসব মাদ্রাসায় পড়ান না

আর এক ধরণের মাদ্রাসা আছে যেগুলোকে এনজিও মাদ্রাসা বলা যায় পশ্চিমা খৃষ্টান এনজিওগুলোর মতো মধ্যপ্রাচ্যেও কিছু এনজিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যারা ইসলামের নামে দান-খয়রাত করে এসব এনজিও থেকে তদবীর করে টাকা এনে অনেক নতুন মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে আমাদের দেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে কর্মরত এনজিওগুলো যেসব স্কুল খুলেছে সেগুলোর যে দশা, মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলোর দশাও তার থেকে ভিন্ন নয়  কিন্তু এসবব্যাংগের ছাতারঅনিয়ম এবং অপকর্মের জন্য বনেদী কওমী মাদ্রাসাগুলোকে দায়ী করলে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হয়

বনেদী কওমী মাদ্রাসা সম্পর্কে সবার জানা উচিৎ, এসব মাদ্রাসায় ধর্ম শিক্ষার পাশা পাশি অন্য যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হয় তা হচ্ছে ভদ্রতা আর নম্রতা আজকের অবক্ষয়ের যুগেও কওমী মাদ্রাসার ছাত্রদের বখাটেপনার কোন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে পত্রিকা পড়ার মত বুদ্ধি হওয়ার সময় থেকে আজ পর্যন্ত আমি সংবাদপত্রে এমন একটা খবরও দেখিনি যে, কওমী মাদ্রাসার কোন ছাত্র অন্য ধর্মের কোন মেয়েকে নিয়ে ভেগেছে কওমী মাদ্রাসার চরম বিরোধিতা কারীরাও একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, এই মাদ্রাসাগুলো অত্যন্ত শৃংখলার সংগে  পরিচালিত হয় মাদ্রাসা কতৃপক্ষ নিজেরা জঙ্গী না হলে এসব মাদ্রাসার কোন ছাত্রের পক্ষে জঙ্গী হয়ে ওঠা কঠিনই শুধু নয়, বরং অসম্ভব বনেদী কওমী মাদ্রাসাগুলোর অধ্যক্ষগণ প্রায় সবাই সমাজে অত্যন্ত সন্মানিত ব্যক্তি মুসলমানরা তো বটেই, এমনকি অন্য ধর্মের স্থানীয় লোকজনও তাঁদের শ্রদ্ধার চোখে দেখে  তারা যদি ধর্মের নামে জংগীপনার সাথে আসলেই জড়িয়ে পড়তেন তবে দেশ জুড়ে হৈ চৈ পড়ে যেত সেক্ষেত্রে জঙ্গী সংখ্যা কয়েক লাখে গিয়ে দাঁড়াতো  

কিন্তু ব্যাপক ধরপাকড়ের পর আমরা দেখছি, যেসব গুণ্ডার সর্দারকে মিডিয়া আদর করে গডফাদার অথবা টপটেরর নামে ডেকে থাকে তাদের অধীনেও জঙ্গিদের চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক গুণ্ডাপাণ্ডা আছে। তাই কওমী মাদ্রাসার জঙ্গি কানেকশনের অভিযোগ হাস্যকর।

কওমী মাদ্রাসাগুলোকে রাজাকারের ঘাঁটি আখ্যা দেয়া হাস্যকরই শুধু নয়, একই সঙ্গে বেদনাদায়ক। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বনেদী কওমী মাদ্রাসাগুলো সব সময় ধর্মশিক্ষার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার লালন করে আসছে। এ কারণে ব্রিটিশ আমলে মুসলিম লীগ সমর্থকরা কওমী মাদ্রাসাগুলোকে কংগ্রেসি মাদ্রাসা বলে ঠাট্টা করত। পাকিস্তান হওয়ার পর এ জন্য কওমী মাদ্রাসাগুলোকে কম মূল্য দিতে হয়নি। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো মন্তব্য না করেও এ কথা বলা যায়, জামায়াত যে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে সমর্থনের ভিত দৃঢ় করতে পারছে না, তার প্রধান কারণ কওমী মাদ্রাসাগুলোর  জামায়াত বিরোধিতা। সর্বোপরি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের পুরোপুরি পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন সত্ত্বেও দাড়ি-টুপিঅলা রাজাকারদের চেয়ে দাড়ি কামানো রাজাকারের সংখ্যা যে অনেক বেশি ছিল ইতিহাস সে কথাই বলে।


চুরি, ছিনতাই, খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধের ঘটনায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিকছাত্ররা হরহামেশা ধরা পড়ছে। বিদেশে লেখাপড়া শিখে মানুষহয়েছে এমন ছাত্ররাও বাদ পড়ছে না। কওমী মাদ্রাসার ছাত্রদের কিন্তু এসব অপকর্মে জড়াতে দেখা যায় না।

আসলে মাদ্রাসা শিক্ষা নিষিদ্ধ করার কথা যারা বলে, তারা গোটা বিষয়টি ঠিকমত তলিয়ে দেখে কিনা আমার অন্তত সন্দেহ আছে। মাদ্রাসা ঘরানার শিক্ষার প্রবর্তন আর ইসলাম ধর্মের অভ্যুদয় প্রায় সমসাময়িক ঘটনা। মাদ্রাসায় শিক্ষিত মুসলমানরাই মুসলিম সাম্রাজ্যের হাল ধরেছেন। ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন দেশে। মুহম্মদ ঘোরির দিল্লী বিজয়ের পর থেকে ভারতে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ১৬০১ সালে ইংরেজ বণিকরা প্রথম যখন ভারতে পা রাখে, তখন শুধু দিল্লী-তে মাদ্রাসা ছিল হাজারের মতো। ইংরেজরা ভারত দখল করার পর কিন্তু দৃশ্যপট পাল্টে যায়। আমরা সবাই জানি, ব্রিটিশদের তাড়িয়ে ভারত স্বাধীন করার প্রথম সংগ্রাম হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। ব্রিটিশরা এই স্বাধীনতা সংগ্রামের নাম দিয়েছে সিপাহী বিদ্রোহ। আমরা ব্রিটিশদের শেখানো আধুনিকবিদ্যায় সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস পড়ি। ফলে অনেক কথা অজানা রয়ে গেছে। ১৮৫৬ সালে দিল্লী-তে আলেমদের এক মহাসম্মেলনে ব্রিটিশবিরোধী লড়াই শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এক বছর পর শুরু হওয়া সে যুদ্ধে বাহাদুর শাহ জাফরকে প্রধান নেতা ঘোষণার সিদ্ধান্তও আলেমরাই নিয়েছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহে ব্রিটিশ বাহিনীর দেশীয় সৈন্যরা ছাড়াও হাজার হাজার আলেম অস্ত্র হাতে অংশ নিয়েছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহ শেষ হওয়ার পর ব্রিটিশরা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, মুসলমানদের ধর্মীয় প্রেরণাই এই বিদ্রোহের জন্য প্রধানত দায়ী। এর ফলে মুসলমানদের ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতন নেমে এসেছিল। ইংরেজ ইতিহাসবিদ টমসন লিখেছেন : ইংরেজরা মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনা নস্যাৎ করার জন্য ১৮৬১ সালে কোরআন শরীফের ৩ লাখ কপি পুড়িয়ে ফেলে। ১৮৬৪ থেকে ১৮৬৭ সালের মধ্যে ৪ বছরে ১৪ হাজার আলেমকে ফাঁসি দিয়ে, গুলি করে এবং আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। গোটা ভারতবর্ষে যতগুলো মাদ্রাসা ছিল, তার প্রায় সবগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়।


এই চরম সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে মাওলানা কাসিম নানুতবী প্রত্যন্ত গ্রাম দেওবন্দে দারুল উলুম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন একটা ডালিম গাছের নিচে। ৩০ মে ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুমের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন মাওলানা মো. মাহমুদুল হাসান। প্রথম ছাত্রের নামও ছিল মাহমুদুল হাসান। এই ছাত্রই ভারতের প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী শায়খুল হিন্দ।


দারুল উলুম প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মৃতপ্রায় মুসলিম সমাজে যে নবজীবনের সঞ্চার ঘটে, তারই পরম্পরায় গড়ে ওঠে কওমী মাদ্রাসাগুলো। অসাম্প্রদায়িক দেশাত্মবোধের চেতনায় মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করা, প্রতিবেশী সমাজের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা ছিল এর উদ্দেশ্য। শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান, শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী প্রমুখ মহামনীষীদের নিরলস চেষ্টায় এই উদ্দেশ্য সার্থকতায় ভরে উঠেছিল। দেওবন্দে দারুল উলুম প্রতিষ্ঠিত না হলে এ উপমহাদেশে মুসলমানদের অবস্থা স্পেনের মতো হতো কিনা জানি না, তবে মুসলমানদের অস্তিত্ব যে হারিকেন দিয়ে খুঁজতে হতো, এ কথা নির্দ্দিধায় বলা যায়। এই ঘরানায় গড়ে ওঠা কওমী মাদ্রাসাগুলো সেই অগ্রসর ধর্মীয় চেতনার প্রতীক। পুড়িয়ে ফেলা ৩ লাখ কপি কোরআন শরীফের ছাই আর ১৪ হাজার অকুতোভয় আলেমের বুকের রক্ত যে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষা ঘরানার ভিত রচনা করেছে, কতিপয় অর্বাচীন আজ তার মধ্যে পশ্চাৎপদতা আর জঙ্গিপনার জীবাণু খুঁজে বেড়ায়। ব্রিটিশদের প্রেতাত্মার আছর থেকে এ জাতি কবে মুক্ত হবে জানি না।