ওলিকূল শিরোমণি হযরত মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর সাহেবযাদা, ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী মারকায জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া আশরাফাবাদ,
কামরাঙ্গীরচর, . ঢাকা-১২১১ এর
মহাপরিচালক
হাফেজ মাওলানা ক্বারী শাহ আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী হুজুর এর
আরজ
নাহমাদুহু ওয়ানুসল্লি ‘আলা রাসূলিহিল কারীম, আম্মাবাদ-
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী ছিল, শেখ মুজিবুুর রহমান কী চেয়েছিলেন, এ বিষয়ে বই লিখতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা দাবীদার ভারতীয় লেখক ডাঃ কালিদাস বৈদ্য “বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব” নামে একটি বই লিখেছেন।
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য তার “বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব” বইয়ে সূরা তাওবার ৫নং আয়াত, সূরা নিসার ৮৯ নং আয়াত, সূরা আনফালের ৩৯ নং আয়াত, সূরা মুহাম্মদের ৪নং আয়াতের অপব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এদেশের মুসলমানরা আল্লাহর হুকুম হিসেবে এই আয়াতগুলি তামীল করতে গিয়ে ত্রিশ লক্ষ হিন্দুকে হত্যা করেছে, হিন্দুদের বাড়ীঘর লুণ্ঠনের পর তা জ্বালিয়ে দিয়েছে, হিন্দু নারীদের নির্যাতনের পর ধর্ষণ করেছে - যা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ হিন্দু হত্যা হয়নি, পবিত্র কুরআনের আয়াতের দোহাই দিয়ে কোন হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করা হয়নি বা হিন্দুদের বাড়ীঘর লুণ্ঠনের পর তা জ্বালিয়ে দেয়া হয়নি। এসব কাজ ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম। কোরআনের আয়াত ১৯৭১ সালে হিন্দুদের হত্যা, তাদের বাড়ীঘর লুণ্ঠন বা হিন্দু নারীদের ধর্ষণের জন্য নাযিল হয়নি।
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য তার “বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব” বইয়ের ৫৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ... ‘শিক্ষাদীক্ষায় মুসলমানদের অনীহার কারণও ইসলামের শিক্ষা। শিক্ষাদীক্ষা ও নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত সৎ মানুষ গড়ার কোনো প্রেরণা ইসলামে নেই। ইসলাম মানুষকে সম্পদ সৃষ্টিতে কোন প্রেরণা যোগায় না। ইসলামের শিক্ষা হল জেহাদ করে পরের সম্পদ ঘরে আনতে হবে। চুরি, ডাকাতিতেই ইসলামের প্রেরণা। ইসলামি মতে ইসলাম হল শ্রেষ্ঠ পথ। এই পথের পথিক বলে একজন মুসলমান পাহাড় প্রমাণ পাপ করলেও সৃষ্টিকর্তার ক্ষমা পাবে। পরলোকে জান্নাত (স্বর্গ) বাসী হবে।”
বইয়ের ৫৫ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, “জেহাদের সারকথা হল, বিধর্মীদের আক্রমণ কর, খুন কর, শূলবিদ্ধ কর, হাত পা কেটে দাও। তবে মুসলমান হতে রাজি হলে ক্ষমা করে দিও। অন্যথায় তাদের ঘর বাড়ি লুট কর, জ্বালিয়ে দাও। তাদের মেয়েদের উপর অত্যাচার চালাও। এইভাবে এক ভয়াবহ সন্ত্রাসের পরিস্থিতি তৈরি কর, যা দেখে বা শুনে অন্যরা ভয় পেয়ে মুসলমান হয়।”
ডাঃ কালিদাস বৈদ্যের “বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব” বইয়ের কারণে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট, সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা রাজনৈতিক স্থীতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। বইটি নিজ দায়িত্বে সংগ্রহ করে প্রত্যেক বিবেকবান মানুুুুুুষের পড়া উচিৎ। বিশেষকরে প্রধানমন্ত্রীর নিজেরও পড়া উচিৎ, মন্ত্রী পরিষদের সকল সদস্যবৃন্দ ও জাতীয় সংসদের সকল সংসদ সদস্যদের পড়া উচিৎ এবং সরকারকে এর একটি সুন্দর সহনশীল সঠিক জবাব দেয়া উচিৎ। মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধসহ সকল সম্প্রদায়ের লোক ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করার জন্য সভা সমাবেশ, মিছিল, আলোচনা সভা, সেমিনার, সেম্পুজিয়ামসহ সবধরনের প্রচেষ্টা চালানো উচিৎ। কারণ বইয়ের বক্তব্য নিয়ে ইদানিংকালে পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশনের টকশো, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, ফেইসবুকসহ সব গণমাধ্যমে ব্যপক আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে।
“আমরা মহান জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্যদের প্রতি আহবান করছি তারা ডাঃ কালিদাস বৈদ্যের বই “বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব” এ পবিত্র কুরআনের আয়াতের অপব্যাখ্যা করে এবং মহান স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিয়ে মিথ্যাচারের জন্য বিষয়টি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করবেন, আলোচনা করবেন এবং নিন্দা প্রস্তাব গ্রহন করবেন”।
ডাঃ কালিদাস বৈদ্যের বই ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব’ এর পাতায় পাতায় হিংসা-বিদ্বেষ ঘৃণা ছড়ানো মিথ্যা আপত্তিকর ও স্পর্শকাতর বক্তব্য আছে। বাংলাদেশের মুসলমানদেরকে ঘৃণ্য নিকৃষ্ট ও ধিকৃত করার এমন কোন বক্তব্য নেই যা ডাঃ কালিদাস বৈদ্য তার বইয়ে করেননি। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুসহ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে অনেক আপত্তিকর ও স্পর্শকাতর বক্তব্য আছে, যা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। বাংলাদেশ মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সকলের। আমরা সবাই ভাই ভাই, সকলে মিলে মিশে এদেশে থাকতে চাই। আমাদের মাঝে এই বইয়ে পবিত্র কোরআন মজীদের আয়াতের অপব্যাখ্যার দ্বারা কোনরূপ রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি না হয়, এজন্য বাংলাদেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, মসজিদের ইমাম-খতীব, ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলির নেতাকর্মীসহ প্রত্যেক মুসলমানের উচিৎ ও ঈমানী দায়িত্ব হচ্ছে, কোরআন মজীদের এই আয়াতগুলির অপব্যাখ্যার দ্বারা যাতে কোনরূপ বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়, সেজন্য প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থানে জুম‘আর বয়ানে, ওয়াজ মাহফিলে অপব্যাখ্যাকৃত আয়াতগুলির সঠিক ব্যখ্যা তুলে ধরে জনগণকে সচেতন করা।
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য কর্তৃককুরআনের ওপর অপবাদ
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য লিখিত ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব’নামক বইয়ের ‘লেখকের কথা’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন-
“ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কোরাণে আমরা দেখতে পাই “... অংশীবাদীদের যেখানে পাবে হত্যা করবে, তাদের বন্দী করবে। অবরোধ করবে এবং প্রত্যেক ঘাটিতে তাদের জন্য ওৎ পেতে থাকবে কিন্তু যদি তারা তওবা করে, নামাজ কায়েম করে, যাকাত দেয়, তবে তাদের পথ মুক্ত করে দেবে” (৯/৫) --- তাদের গ্রেপ্তার করবে, যেখানে পাও হত্যা কর, এবং তাদের সাথে বন্ধুত্ব কর না- (৪/৮৯).. “তাদের সাথে অবিরাম যুদ্ধ কর যতক্ষণ না আল্লার রাজত্ব কায়েম হয় (৮/৩৯) ... তাদের গর্দানে আঘাত কর (৪৭/৪) .... তাদের হাত, পা কেটে ফেল, শূল বিদ্ধ কর ও হত্যা কর” ইত্যাদি ভিন্নধর্মী বা অমুসলমানদের খতম করতে আল্লা নিজেই এরূপ অনেক নির্মম আদেশ দিয়েছেন। আমরা দেখতে পাই, ৯/৫ নং আয়াতে সন্ত্রাসবাদের নির্দেশ আছে। সেই সন্ত্রাসবাদ আজ আত্মঘাতী সন্ত্রাসবাদের রূপ নিয়েছে। ”
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য কর্তৃক কুরআনের উপর আরোপিতঅপবাদের জবাব
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য কুরআনুল কারীমের উপরোক্ত ৪টি আয়াতের মাধ্যমে ‘মহান আল্লাহকে সন্ত্রাসবাদের নির্মম নির্দেশদাতা এবং কুরআনে সন্ত্রাসবাদের নির্দেশ আছে’ এমনটি দাবী করেছেন। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হলো- কুরআনুল কারীমের কোন আয়াত ও তার হুকুম বুঝতে হলে পূর্বাপরের আয়াত, অবতীর্ণের প্রেক্ষিত, অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে অবগতি থাকা অত্যাবশ্যকীয়। অন্যথায় কুরআনের কোন আয়াতের হুকুম, ব্যাখ্যা বা মর্ম বুঝা সম্ভব নয়। অথচ ডাঃ কালিদাস বৈদ্য মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী প্রমাণ করতে সকলের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর ব্যপারে কথা বলতে দ্বিধা করেননি। আয়াতের অপব্যখ্যা করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানী দিচ্ছেন। পারস্পরিক সহাবস্থান, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বিনষ্টের সুগভীর চক্রান্তের বীজ বপন করছেন।
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য উত্থাপিত ৪টি আয়াতের বিধি-বিধান, প্রেক্ষাপট ইত্যাদি নিম্নে উল্লেখ করা হলো
প্রথম আয়াত: সূরা নিসা, ৮৯ নং আয়াত।
فَإِن تَوَلَّوْاْ فَخُذُوهُمْ وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ وَجَدتَّمُوهُمْ- سورة النساء- ৮৯
আয়াতের তরজমা
তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় (আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে হিজরত না করে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত অব্যাহত রাখে) তাহলে তাদেরকে পাকড়াও কর এবং যেখানে পাও হত্যা কর।
আয়াতের শানে নুযূল ও তাফসীর
আলোচ্য আয়াতটি এবং তাতে বর্ণিত হুকুম নাজিল হয়েছিল মুনাফিকদের ক্ষেত্রে। আল্লাহর নির্দেশে মুহাম্মদ (সাঃ)যখন হিজরত করে মদীনায় চলে যান, তখন মুসলমানদের জন্য হিজরত করা ততটাই আবশ্যক ছিল- যতটা আবশ্যক ছিল ইসলামের জন্য কালিমায়ে শাহাদাতের সাক্ষ্য দেয়া। কিন্তু মক্কায় তখন এমন কিছু মুনাফিক ছিল, যারা মদীনায় গিয়ে বিশ্বনবী সা. ও সাহাবীদের সামনে নিজেদের ঈমান যাহির করতো আর মক্কায় ফিরে এসে মুশরিকদের সাহায্য করতো এবং কীভাবে মুসলমানদের ক্ষতি সাধন করা যায় সে চক্রান্ত করতো। তাই আল্লাহ তায়ালা সে সকল মুনাফিকের ব্যপারে হুকুম নাযিল করলেন-
فَإِن تَوَلَّوْاْ فَخُذُوهُمْ وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ وَجَدتَّمُوهُمْ- - سورة النساء- ৮৯
অর্থাৎ তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় (আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে হিজরত না করে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত অব্যাহত রাখে) তাহলে তাদেরকে পাকড়াও কর এবং যেখানে পাও হত্যা কর।
আল্লাহ তায়ালা এই হুকুম নাযিল করার পাশাপাশি তাদের মুক্তির পথও দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তবে এ সকল মুনাফিকের মুক্তির জন্য দুটি পথ রয়েছে, যথা-
---।১। إِلاَّ الَّذِينَ يَصِلُونَ إِلَىَ قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُم مِّيثَاقٌ--।২أَوْ جَآؤُوكُمْ حَصِرَتْ صُدُورُهُمْ أَن يُقَاتِلُوكُمْ أَوْ يُقَاتِلُواْ قَوْمَهُمْ
১. তবে যারা সে গোত্রের সাথে মিলিত হবে যাদের সাথে তোমাদের সন্ধিচুক্তি রয়েছে।
২. অথবা তারা সরাসরি তোমাদের কাছে এ অবস্থায় আসবে যে, তাদের অন্তর তোমাদের সাথে এবং তাদের স্বজাতির সাথে যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক।
এতএব, আয়াতে কারীমার মূল শিক্ষা এবং নির্দেশনা হল, যদি তারা যুদ্ধ এবং চক্রান্ত থেকে নিবৃত্ত হয়, তাহলে তোমরা তাদেরকে হত্যা করো না। যেমন আল্লাহ তায়ালা পরবর্তী আয়াতে আরো সুস্পষ্টভাবে বলেছেন-
فَإِنِ اعْتَزَلُوكُمْ فَلَمْ يُقَاتِلُوكُمْ وَأَلْقَوْاْ إِلَيْكُمُ السَّلَمَ فَمَا جَعَلَ اللَّهُ لَكُمْ عَلَيْهِمْ سَبِيلاً - النساء(৯০)
সুতরাং তারা যদি তোমাদের থেকে নির্লিপ্ত হয় এবং তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে ও তোমাদের কাছে সন্ধির প্রস্তাব পেশ করে তবে আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে তাদের বিরুদ্ধে (যুদ্ধ করার) কোন সুযোগ রাখেননি। (৪:৯০)খ্যাতিমান মুফাসসির আল্লামা রাযী রহ. এ আয়াতের তাফসীরে লিখেন-
وهذا يدل على أن السبب الموجب لترك التعرض لهم هو تركهم للقتال- التفسير الكبير- ج ১০- ص- ২২৯)
এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, কোন বিধর্মী মুসলমানদের ওপরে আক্রমন না করলে তাদেরকে আক্রমন করার সুযোগ নেই।
* অতএব, আয়াতের সঠিক তাফসীর জানার পর আমরা নির্দ্ধিধায় বলতে পারি, বর্তমান জামানায় ইসলাম ও মুসলমানের যে সকল দুশমন কুরআনুল কারীমের উক্ত আয়াতের ভুল ব্যখ্যা করে ইসলাম ও মুসলমানদের সন্ত্রাসী সাব্যস্ত করতে চায়, মুসলমানদের নামে অপবাদ রটায় এবং নিজেদের দাবীর স্বপক্ষে উক্ত আয়াতে কারীমাকে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করে, তারা মূলত নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনে ধূম্রজাল সৃষ্টি করছে। তারা বর্ণিত আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াত বাদ দিয়ে লাফ দিয়ে এই আয়াতে চলে আসে, আবার এর পরবর্তী আয়াত; যাতে সুন্দর সমাধান রয়েছে সেটাও উল্লেখ করে না।
অতএব,আয়াতের পূর্বাপরের দিকে লক্ষ করলে যায়, এসব তাদের অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ফসল বৈ কিছুই নয়। তেমনি এ কথাও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই আয়াত এবং তাতে বর্ণিত হুকুম আজ থেকে চৌদ্দশত বছর পূর্বের মুনাফিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এর সাথে ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কোন সম্পর্ক নেই। মুক্তিযুদ্ধের সাথে এই আয়াতকে সম্পৃক্ত করা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
দ্বিতীয় আয়াত: সূরা তাওবার ৫ নং আয়াত
فَإِذَا انسَلَخَ الأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُواْ الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدتُّمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُواْ لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ الصَّلاَةَ وَآتَوُاْ الزَّكَاةَ فَخَلُّواْ سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ (৫) التوبة
আয়াতের তরজমা
অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদের হত্যা কর যেখানে তাদেরকে পাও, তাদের বন্দী কর এবং অবরোধ করো। আর প্রত্যেকটি ঘাটিতে তাদের সন্ধানে ওঁৎ পেতে থাক। তবে তারা যদি তাওবা করে নামায কায়েম করে যাকাত আদায় করে তবে তাদেরকে পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সূরা তওবা; ৫)
আয়াতের শানে নুযূল ও তাফসীর
روي أن النبي صلى الله عليه وسلم لما خرج إلى غزوة تبوك وتخلف المنافقون وأرجفوا بالأزاجيف جعل المشركون ينقضون العهد فنبذ النبي عليه السلام العهد اليهم-
নবী করীম সা. মক্কার থেকে হিজরত করে মদিনায় চলে যাওয়ার পর যখন ইসলাম ও মুসলমানগণের ভিত্তি কিছুটা মজবুত হল তখন নবী সা. মক্কার কোন কোন মুশরিক গোত্রের সাথে সন্ধি-চুক্তি করলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই কয়েকটি গোত্র চুক্তি ভঙ্গ করল, বনু বকর যাদের অন্যতম। তাই যেহেতু তারা সন্ধিচুক্তি রক্ষা করেনি, এজন্য আল্লাহ তায়ালাও মুসলমানদেরকে তাদের সাথে সন্ধিমুক্তির চূড়ান্ত ঘোষণা সম্বলিত আয়াত অবতীর্ণ করেন এবং সন্ধি ভঙ্গের শাস্তি বর্ণনা করেন।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা বুঝা যায়, আয়াতে প্রদত্ত হত্যা এবং অন্যান্য হুকুম সমূহ প্রযোজ্য হবে ঐ সকল মুশরিকদের ক্ষেত্রে, যারা নিজেদেরকৃত সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে। একটু ভাবুন তো, কেউ সন্ধিচুক্তি করে তা ভঙ্গ করলে, তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া কি অন্যায়?
দুঃখজনক কথা হলো, ইসলামের দুশমনরা উক্ত আয়াতে কারীমাকেও নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য ব্যবহার করার চেষ্টা করে। তারা আয়াত নাজিল হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবগত নয় অথচপবিত্র কুরআনের কোন আয়াতের হুকুম যথার্থ বুঝার জন্য নিয়ম হলো, সে আয়াতটির প্রেক্ষাপটের প্রতি লক্ষ্য করা। তেমনি তারা পূর্বাপরের আয়াতগুলোর প্রতিও লক্ষ্য করে না, যেখানে এ জাতীয় বিভিন্ন প্রশ্নের সুস্পষ্ট সমাধান রয়েছে । যেমন উক্ত আয়াতের পূর্বের আয়াতে বলা হয়েছে-
إِلاَّ الَّذِينَ عَاهَدتُّم مِّنَ الْمُشْرِكِينَ ثُمَّ لَمْ يَنقُصُوكُمْ شَيْئًا وَلَمْ يُظَاهِرُواْ عَلَيْكُمْ أَحَدًا فَأَتِمُّواْ إِلَيْهِمْ عَهْدَهُمْ إِلَى مُدَّتِهِمْ
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ (৪) التوبة
যাতে চুক্তি রক্ষাকারী মুশরিক এবং যে সকল মুশরিক মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য না করবে, তাদের সাথে প্রতিশ্রæতি রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আবার পরবর্তী আয়াত যাতে সুস্পষ্টই মুশরিকদের মুক্তির পথ এবং তাদেরকে নিরাপদ স্থানে পৌছে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَإِنْ أَحَدٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّى يَسْمَعَ كَلاَمَ اللَّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لاَّ يَعْلَمُونَ (৬)
আর যদি মুশরিকদের কেউ আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে তবে তাকে আশ্রয় দিন। যেন সে আল্লাহর বাণী শুনে নেয়। অতপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌছে দিন। (এ বিধান) এজন্য যে, তারা এমন সম্প্রদায় যারা (কিছুই) জানে না। সূরা তওবা; ৬।
আয়াতের তাফসীরে প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা রাযী রহ. লিখেন-
نقل عن ابن عباس أنه قال : إن رجلا من المشركين قال لعلي بن أبي طالب : إن أردنا أن نأتي الرسول بعد انقضاء هذا الأجل لسماع كلام الله أو لحاجة أخرى فهل نقتل ؟ فقال علي : "لا" إن الله تعالى قال :( وإن أحد من المشركين استجارك فأجره ) أي فأمنه حتى يسمع كلام الله-
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক মুশরিক হযরত আলী রাযি. কে বললেন, আমরা যদি চুক্তি শেষ হওয়ার পরে আল্লাহর বাণী শুনতে বা অন্য কোন প্রয়োজনে নবীর নিকট আসতে চাই তবে কি আমাদেরকে হত্যা করা হবে? তখন হযরত আলী (রাযিঃ) বললেন, না । (হত্যা করা হবে না।) কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যদি মুশরিকদের কেউ আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে তবে তাকে আশ্রয় দিন। যেন সে আল্লাহর বাণী শুনে নেয়। অতপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌছে দিন । (সূরা তওবা: ৬)
অতএব আয়াতে কারীমার পূর্বের চার নম্বর আয়াত এবং পরবর্তী ছয় নম্বর আয়াতে পাঁচ নম্বর আয়াতে বর্ণিত মূল হুকুমের সঠিক ক্ষেত্র বলে দেয়া হয়েছে এবং এটাই আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনা। এতে কোন নির্দোষ মুশরিককে যেখানে সেখানে হত্যা করতে বলা হয়নি বরং যদি মুশরিক মুসলমানদের আশ্রয়ে আসে ইসলাম গ্রহণ না করলেও তাকে নিরাপদ স্থানে পৌছে দেয়া মুসলমানদের ওপর আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত দায়িত্বআর যদি ইসলাম মেনে নেয় তাহলে তো তারা আমাদের ভাই।
অথচ ডাঃ কালিদাস বৈদ্য৪ নম্বর আয়াত না দেখে, না বুঝে৫ নম্বার আয়াত নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি করছেনএবং পরবর্তী আয়াতগুলো যেখানে সমাধান রয়েছে সেগুলো না দেখার ভান করে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, ইসলাম কোন নির্দোষ মানুষকে হত্যা করতে সমর্থন করে না। উপরন্তু ইসলাম নির্দোষ মানুষ হত্যা করাকে কঠোরভাবে অনুৎসাহিত করেছে।পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ হচ্ছে-
مَن قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا- سورة المائدة- ৩২
যে ব্যক্তি কোন প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ বা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করল এবং যে ব্যক্তি কারো জীবন রক্ষা করল, সে যেন সমগ্র মানব জাতিকে রক্ষা করল। (৫; ৩২)
আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষিত
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে এমন সম্প্রদায়ের ব্যপারে, যারা মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে যাহির করত আর গোপনে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের সহযোগিতা করতো, এ কারণে মুসলমানগণ তাদের ব্যপারে মতানৈক্যে পড়ে গেলেন এবং বিতর্ক করতে লাগলেন, তারপরেই আয়াতটি অবতীর্ণ হল। (তাফসীরে মুনীর: খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-১৯৯)
যে সকল মুনাফিকদের ব্যপারে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল, তারা হল- আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার সাথীবর্গ। যারা উহুদের যুদ্ধের দিন নবী সা.কে ময়দানে রেখে সাথীদেরকে নিয়ে পালিয়েছিল।
আয়াতের হুকুম:
মুনাফিকদের বন্দি করা এবং হত্যা করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়’ অর্থাৎ যদি তারা আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য দেয়া এবং হিজরত করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তাদেরকে বন্দি এবং হত্যা কর যেখানে পাও।
আল্লামা শারাভী (রহঃ) স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে লেখেন, আয়াতে একটি সন্ধিচুক্তির বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যা রাসূল সা. কোন কোন আরব্য গোত্রের সাথে করেছিলেন আর এ সকল চুক্তি স্বীকৃতি দেয় যে, নবী করীম সা. গোত্রগুলোর সাথে এই মর্মে চুক্তি করেছিলেন যে, তারা মুসলমানদের উপর আক্রমন করবে না এবং মুসলমানরাও তাদের উপর আক্রমন করবে না।
আল্লামা আলুসী রহ. তাফসীরে রুহুল মা’আনী তে বলেছেন- আল্লাহর বাণী فَإِن تَوَلَّوْاْ অর্থাৎ যদি তারা আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে মসজিদে হারামের ভিতরে/বাইরে যেখানে তাদেরকে পাও বন্দী কর এবং হত্যা কর।
তবে হে মুসলমান সম্প্রদায়, আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ (হত্যা এবং বন্দির এই নির্দেশ) যখন তখন ব্যাপকভাবে সবসময়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ ইসলাম হল অঙ্গীকার রক্ষাকারী দ্বীন আর তোমরাতো কতিপয় গোত্রকে অঙ্গীকার প্রদান করেছো যে, তাদের কেউ মুসলমানদের আশ্রয়ে এলে অনুরূপ কেউ মুসলমান হয়ে তাদের কাছে গেলে তাদের দায়িত্ব হল, তার হেফাজত করা এবং তার উপর যেকোন বাড়াবাড়ি প্রতিহত করা। আর এজন্যই আল্লাহ তায়ালা আয়াতের শেষে মূল বিধানের ব্যতিক্রম করে বলেছেন- إِلاَّ الَّذِينَ يَصِلُونَ তবে যারা এমন গোত্রে গিয়ে পৌছবে যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে তারা নিরাপদ। (সূরা নিসা- ৯০)
আল্লমা ফখরুদ্দীন রাযী (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
فَإِن تَوَلَّوْاْ فَخُذُوهُمْ وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ وَجَدتَّمُوهُمْ- - سورة النساء- ৮৯
আয়াতের উদ্দেশ্য হল, যদি তারা হিজরত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং মদিনার বাইরে তাদের অবস্থান নির্দিষ্ট করে নেয়, তাহলে যখন তোমরা তাদের পাও, যেখানেই পাও, হত্যা কর আর এ অবস্থায় কিছুতেই তাদের কাউকে এমন বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যে তোমাদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আঞ্জাম দিবে এবং সাহায্যকারী রূপেও গ্রহণ করো না, যে শত্রæর বিরুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করবে। জেনে রাখুন, যখন আল্লাহ তায়ালা হত্যার নির্দেশ দিলেন, তখন এই নির্দেশ থেকে দুই প্রকার লোককে আলাদা রেখেছেন।
১। إِلاَّ الَّذِينَ يَصِلُونَ তবে যারা এমন গোত্রের সাথে মিলিত হবে যাদের মাঝে এবং তোমাদের মাঝে সন্ধি চুক্তি বিদ্যমান।
২। أَوْ جَآؤُوكُمْ حَصِرَتْ صُدُورُهُمْ অথবা যারা এই এই প্রতিজ্ঞা করে তোমাদের কাছে এসেছে যে, তারা তোমাদের সাথে এবং স্বীয় গোত্রের সাথে যুদ্ধ করবে না। (তাফসীরে কাবীর: ১০/ ২২৮)
আল্লামা শাহ আশরাফ আলী থানবী রহ. বয়ানুল কুরআনে বলেন- সে সময় হিজরতের ঐ হুকুম ছিল, যেই হুকুম বর্তমানে মুসলমানদের জন্য কালিমায়ে শাহাদাতের সাক্ষ্য দেওয়া।
আব্দুল্লাই ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। একজন মুশরিক হযরত আলী রাযি.কে বললো, হে আলী! আমরা যদি উক্ত দিনগুলি অতিবাহিত হওয়ার পর রাসূল সা. এর কাছে কুরআন শ্রবণ বা অন্য কোন প্রয়োজনে আসতে চাই তাহলে আমাদেরকে কি হত্যা করা হবে? তখন আলী রাযি. বললেন, না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, وَإِنْ أَحَدٌ মুশরিকদের কেউ যদি তোমাদের আশ্রয় প্রার্থনা করে তাহলে তাদের আশ্রয় দাও। যাতে সে আল্লাহর বাণী শ্রবণ করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, আয়াতের উদ্দেশ্য হল, এ কথা ব্যক্ত করা যে, যখন কোন বিধর্মী ইসলামের ব্যপারে কোন দলীল-প্রমাণ জানতে চায় বা কুরআনের বাণী শ্রবন করতে চায় তাহলে তাকে সুযোগ দেয়া ওয়াজিব। তাকে হত্যা করা হারাম এবং নিরাপদ স্থানে তাকে পৌছে দেয়া। (তাফসীরে রাযী: ১৫/২৩৫)
আল্লামা সাইয়েদ কুতুব (রহঃ)তাফসীর ফী যিলালীল কুরআনে বলেন, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মুশরিকদেরকে নির্দিষ্ট চার মাস অতিবাহিত হওয়ার পরে পূর্ণরূপে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেওয়াটা ইসলাম ধর্মের উদার দৃষ্টিভঙ্গি। তার উত্তমতা এবং বাস্তবমূখী হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করে। অনুরূপ উক্ত আয়াতে সকল মুশরিককে হত্যা বা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলা হয়নি। যেমনটি অনেকে বলে থাকে।
অতএব, কোন মুশরিক (যাকে জাহিলী কোন অজ্ঞতা গ্রাস করেনি) সে যদি ইসলামের জন্য নিজেকে পেশ করে এবং ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয় তাহলে ইসলাম তাদেরকে ইসলামী রাষ্ট্রে পূর্ণ নিরাপত্তার ভার প্রদান করে আর আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা.কে নির্দেশ দিয়েছেন,তিনি যেন মুশরিকদের আল্লাহর কালাম শ্রবণ এবং দ্বীনী দাওয়াত পরিপূর্ণরূপে তাৎপর্য সহকারে জানারসুযোগ করে দেন এবং তাদেরকে নিরাপদ স্থানে পৌছে দেওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা প্রদান করতে। এ সকল উদারতা ও নিরাপত্তা প্রদানের নির্দেশ ঐ সময়ের জন্য প্রযোজ্য হবে, যখন (وَإِنْ أَحَدٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ)মুশরিকদের কেউ তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করে। যদি আশ্রয় চায় তবে তাকে আশ্রয় দাও। (তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন)
সূরা আনফালের ৩৯ নং আয়াত:
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلّه فَإِنِ انتَهَوْاْ فَإِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ بَصِيرٌ (৩৯)
আয়াতের তরজমা:
আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক, যতক্ষণ না ফিতনা শেষ হয়ে যায় এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হয়ে যায়।
আয়াতের তাফসীর:
বর্ণিত আয়াতে কারীমাকে ইসলামের দুশমনরা বিকৃতভাবে মানুষের সামনে প্রচার করে বেড়ায় আর সকলের কাছে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী বলে চিত্রায়িত করতে চায়। অথচ উক্ত আয়াতের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী আয়াত সমূহ অধ্যয়ণ করলে তাদের উত্থাপিত এ অসার দাবী এবং সর্বপ্রকার সংশয় দূরীভূত হয়ে যায়। পাঠক, একটু মনোযোগ দিয়ে পূর্বাপর আয়াতগুলো লক্ষ্য করুন। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَمَا لَهُمْ أَلاَّ يُعَذِّبَهُمُ اللَّهُ وَهُمْ يَصُدُّونَ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَمَا كَانُواْ أَوْلِيَاءهُ إِنْ أَوْلِيَآؤُهُ إِلاَّ الْمُتَّقُونَ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ (৩৪)
(তরজমা) আর তাদের কী বা গুণ আছে যে, আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন না অথচ তারা মানুষকে মসজিদুল হারামে যেতে বাধা দেয়, যদিও তারা তার রক্ষক নয়। মুত্তাকীগণ ছাড়া অন্য কোনও লোক তার রক্ষক হতেই পারে না। কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোক (এ কথা) জানে না। (সূরা আনফাল: আয়াত- ৩৪)
وَمَا كَانَ صَلاَتُهُمْ عِندَ الْبَيْتِ إِلاَّ مُكَاءوَتَصْدِيَةً فَذُوقُواْ الْعَذَابَ بِمَا كُنتُمْ تَكْفُرُونَ (৩৫)
(তরজমা) বাইতুল্লাহর নিকট তাদের নামায শিশ দেয়া ও তালি বাজানো ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং তোমরা যে কুফরী কাজকর্ম করতে, তজ্জন্য এখন শাস্তি ভোগ কর। (সূরা আনফাল: আয়াত- ৩৫)
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُواْ يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ لِيَصُدُّواْ عَن سَبِيلِ اللَّهِ فَسَيُنفِقُونَهَا ثُمَّ تَكُونُ عَلَيْهِمْ حَسْرَةً ثُمَّ يُغْلَبُونَ وَالَّذِينَ كَفَرُواْ إِلَى جَهَنَّمَ يُحْشَرُونَ (৩৬)
অর্থ: যারা কুফর অবলম্বন করেছে, তারা আল্লাহর পথে মানুষকে বাঁধা দেওয়ার জন্য নিজেদের অর্থ সম্পদ ব্যয় করে।
قُل لِلَّذِينَ كَفَرُواْ إِن يَنتَهُواْ يُغَفَرْ لَهُم مَّا قَدْ سَلَفَ وَإِنْ يَعُودُواْ فَقَدْ مَضَتْ سُنَّةُ الأَوَّلِينِ (৩৮)
(তরজমা) হে নবী! যারা কুফর অবলম্বন করেছে, তাদেরকে বলে দাও তারা যদি নিবৃত্ত হয় তবে অতীতে যা কিছু হয়েছে তা ক্ষমা করে দেওয়া হবে। কিন্তু তারা যদি পুনরায় সে কাজই করে তবে পূর্ববর্তী লোকদের সাথে যে আচরণ করা হয়েছে তা তো (তাদের সামনে) রয়েছেই।
লক্ষ করুন, পূর্বের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের অন্যায় কাজের কথা উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ কাফেররা মুসলমানদেরকে তাদের প্রাণকেন্দ্র মসজিদুল হারামে প্রবেশের অধিকার থেকে বাঁধা প্রদান করত। তারপর আল্লাহ তায়ালা নবী (সাঃ) কে পূর্ববর্তী উম্মতদের বাড়াবাড়ির কারণে তাদের যে পরিণতি হয়েছিল তা উল্লেখ করে ভীতি প্রদর্শনের নির্দেশ দেন। তা হল, যখনি পূর্ববর্তী উম্মতগণের মাঝে কোন নবী আসতেন এবং তাদের উম্মতেরা যদি তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করত তখন সে নবী তাদের উপর আল্লাহ তায়ালার আযাবের কামনা করতেন। এরপরে তারা যদি এরূপ অন্যায় থেকে কোনক্রমেই নিবৃত্ত না হয় তখন আপন হক্ব আদায়ের জন্য তাদের সাথে যুদ্ধ করতে নির্দেশ প্রদান করেন। যাতে মসজিদুল হারাম কাফেরদের হাত থেকে মুক্ত হয় এবং তাতে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করা হয়। আর এভাবেই দ্বীন পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়। কারণ কাফেররা তখন কাবার পার্শ্বে বহু মূর্তিও স্থাপন করেছিল এবং পূঁজা করত।
অতএব উল্লেখিত বিবরণে এ কথা স্পষ্ট হল যে, এ সকল আয়াতে ঐ সকল কাফেরদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, যারা ইসলামের ক্ষতি-সাধনের জন্য তাদের অর্থ ব্যয় করত, মুসলমানদেরকে তাদের মসজিদে প্রবেশে বাঁধা দান করত- এমন ক্ষেত্রে তাদের সাথে যুদ্ধ করা মুসলমানদের জন্য আবশ্যক হয়ে পড়ে।
এখানে সাধারণ বিধর্মীদের ব্যপারে বলা হয়নি। বরং যারা সন্ত্রাসী বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী তাদের বিরুদ্ধে বলা হয়েছে। সন্ত্রাসী যেই হোক তাকে প্রতিহত করতে কে না বলে? হ্যাঁ, তারা যদি আগেই এ ধরণের অন্যায় কাজ থেকে নিবৃত্ত হয় তাহলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে এবং পূর্বের কৃত অপরাধও মাফ করে দেওয়া হবে। বরং কত উদার নীতির কথাই না বলা হল অথচ ডাঃ কালিদাস বৈদ্য ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কুরআনকে সন্ত্রাসের উস্কানীদাতা বলে নির্লজ্জ মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালা উক্ত আয়াতে কোন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা বা কারো বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দেননি। বরং কারো অপরাধ প্রমাণিত হলে মানব জাতির কল্যাণেই এ বিধানটি দিয়েছেন। আপনি জেনে থাকবেন যে, নিরপরাধ মানুষকে হত্যার ব্যপারে ইসলাম বড় কঠোর।পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করাকে গোটা মানবজাতিকে হত্যার নামান্তর বলে ঘোষণা দিয়েছেন বিপরীতে একজন মানুষের প্রাণ রক্ষা করাকে গোটা মানব প্রাণ রক্ষা করারশামিল বলে ব্যক্ত করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
مَن قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا- سورة المائدة- ৩২
যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টির কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করল, সে যেন সকল মানুষকেই হত্যা করল এবং যে কারো জীবন রক্ষা করল, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করল। (৫: ৩২) আশাকরি, পূর্বাপরের আয়াত এবং নিরপরাধ মানুষ হত্যার ব্যপারে কুরআনের কঠোর অবস্থানের বিষয়টি জানার মাধ্যমে আপনার মনের সৃষ্ট প্রশ্নের সমাধান পাওয়া গেছে।
সূরা মুহাম্মদের ৪ নং আয়াত
আল্লাহ তায়ালা বলেন-
فَإِذا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتَّىإِذَا أَثْخَنتُمُوهُمْ فَشُدُّوا الْوَثَاقَ فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاء حَتَّى تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا ذَلِكَ وَلَوْ يَشَاء اللَّهُ لانتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍ وَالَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَلَن يُضِلَّ أَعْمَالَهُمْ (৪)
আয়াতের তরজমা:
অতঃপর যখন তোমরা কাফেরদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও তখন তাদের গর্দানে মার, অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাভূত কর তখন তাদেরকে শক্ত করে বেধে ফেল। অতঃপর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, না হয় তাদের নিকট হতে মুক্তিপণ লও। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে যে পর্যন্ত না শত্রু পক্ষ অস্ত্র সমর্পন করবে। তোমাদের প্রতি এটাই নির্দেশ। আল্লাহ চাইলে নিজেই তাদেরকে শাস্তি দিতেন কিন্তু তিনি তোমাদের একজনকে অপরের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান। আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, আল্লাহ কখনই তাদের কর্মফল নিস্ফল করবেন না। (সূরা মুহাম্মদ-৪)
উক্ত আয়াতে কারিমার প্রেক্ষাপটের প্রতি লক্ষ্য না করে কেবল বাহ্যিক অবস্থার বিবেচনায় ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমনরামুসলমানদেরকে এ বলে অপবাদ দেয় যে, আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে যখনি কোন মুশরিকদের সাথে যে কোন স্থানে সাক্ষাত হয় তাদেরকে কোন অপরাধ ব্যতিত হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আয়াতের তাফসীর:
আয়াতের প্রতি লক্ষ্য করুন। এখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনحَتَّى تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا যতক্ষণ না শক্রপক্ষ অস্ত্র সমর্পণ করবে। অর্থাৎ আয়াতটি মূলত যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রæপক্ষ যখন অস্ত্র নিয়ে আক্রমন বা হত্যা করছে, সে সময় সংক্রান্ত। যুদ্ধ চলাকালীন একজন সৈনিকের ভূমিকা কী হবে, সে ব্যপারে এখানে নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। এটা স্বাভাবিক সময়ের বিষয় নয়। আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ওয়াহবাতুয যুহাইলী রহ. তাফসীরে মুনীরে লেখেন-
وذلك حتى لا يكون حرب مع الكفار ولا قتال ، بأن يضع الأعداء المحاربون أوزارهم ، وهو سلاحهم بالهزيمة أو الموادعة ، أي إن غاية هذه الأوامر إنهاء الحرب والقتال. وهذا في الحقيقة حث على السلم المستتب ، ليعيش الناس في سلام وأمان ، ويتم تبادل الأفكار ، وتنتشر دعوة الإسلام بالحكمة والإقناع ، والحجة والبرهان ، والموعظة الحسنة ، فليس انتشار الإسلام بالسيف كما يتصور بعضالأعداء ، وإنما كان انتشاره بالقناعة الذاتية ، وبالاستحسان الحر الطليق دون إجبار ولا إكراه : (لا إِكْراهَ فِي الدِّينِ) [البقرة ٢ / ٢٥٦].
যুদ্ধের ময়দানে এমন নির্দেশ আল্লাহ তায়ালা এজন্য দিয়েছেন, যাতে কাফেরদের সাথে আর কোন যুদ্ধ না থাকে অর্থাৎ তারা হয়তো যুদ্ধে পরাজিত হবে বা অঙ্গিকারের ভিত্তিতে অস্ত্র সমর্পণ করবে। মূলত: এ নির্দেশের চূড়ান্ত টার্গেট হল, যাবতীয় যুদ্ধ বিগ্রহের ইতিটানা। এ নির্দেশ স্বাভাবিক স্থীতিশীলতা বজায় রাখার প্রতি উৎসাহ প্রদান করার জন্য। যাতে মানুষ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে পারে এবং সুকৌশলে, সাগ্রহে, দলীল-প্রমাণ ও সদুপদেশের মাধ্যমে ইসলামের বিস্তৃতি ঘটে। ইসলামের প্রচার-প্রসার মোটেই তরবারীর দ্বারা হয়নি, যেমনটি ডাঃ কালিদাস বৈদ্য বুঝাতে চেয়েছেন বরং ইসলামের প্রচার-প্রসার লাভ করেছিল মহৎ চরিত্র এবং স্বাধীনচেতা উদার কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে। জোর-জবরদস্তির মাধ্যমে নয়। তাইতো কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, لاإكراه فى الدين দ্বীনের ক্ষেত্রে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। অন্যত্র বলেছেন, وماجعل عليكم فى الدين من حرجতিনি তোমাদের জন্য ধর্ম পালনে কোন কঠোরতা আরোপ করেননি। সূরা হজ্ব-৭৮।
ইসলাম এতটাই উদার যে, মুসলিম দেশের সংখ্যালঘু বিধর্মীদের জান-মালের নিরাপত্তার প্রতি গুরুত্বারোপ করে ইসলামের মহানবী, মানবতার কান্ডরী মুহাম্মদ সা. বলেছেন, তাদের (বিধর্মীদের) প্রাণের (নিরাপত্তার গুরুত্ব) আমাদের (মুসলিমদের) প্রাণের মতই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ধন-সম্পদের নিরাপত্তাবিধান নিশ্চিত করা আমাদের ধন-সম্পদের নিরাপত্তার মতই।
পরিশেষে আমরা দ্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, মহান আল্লাহ তায়ালা অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করার নির্দেশ দেননি। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা, সন্ত্রাসীকর্মকান্ড নির্মূল ও প্রতিহত করার জন্য কিছু কঠোর আইন ও বিধি-বিধান প্রণয়ন করেছেন। যে শত্রু অন্যায়ভাবে প্রতিপক্ষের ওপর অস্ত্রধারণ করে তাকে প্রতিহত করতে বলেছেন। তার সাথে কঠোর আচরণ করা কি অপরাধ? নাকি এটাই আইন ও নীতির দাবী।
আল্লাহর এ হুকুমগুলো অমুসলিম সন্ত্রাসীদের ব্যপারে। সন্ত্রাসী যে ধর্মেরই হোক না কেন তাকে কঠোর আইনের আওতায় আনা এটাই মানবতার দাবী। আল্লাহ বলেছেন-ولكم فى القصاص حيوة এখানে মুসলিম/ অমুসলিম সবার ক্ষেত্রেই এই হুকুম। শুধু বিধর্মী নয়। কোন মুসলিম অপরাধ করলেও তাকে আইনের আওতায় এনে হত্যা করা ইসলামেরই বিধান। তাই মুখ্য ধর্ম নয় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। সমাজে শান্তির পরিবেশ বহাল রাখার জন্য এ ব্যপারে করো ছাড় নেই।
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য তার “বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব” বইয়ের ৫৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ...
‘শিক্ষাদীক্ষায় মুসলমানদের অনীহার কারণও ইসলামের শিক্ষা। শিক্ষাদীক্ষা ও নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত সৎ মানুষ গড়ার কোনো প্রেরণা ইসলামে নেই। ইসলাম মানুষকে সম্পদ সৃষ্টিতে কোন প্রেরণা যোগায় না।”
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য লিখেছেন, "শিক্ষাদীক্ষা ও নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত সৎ মানুষ গড়ার কোনো প্রেরণা ইসলামে নেই।"
অথচ কুরআনে যে সাড়ে ছয় হাজারের বেশী বাক্য রয়েছে তার মধ্যে সর্বপ্রথম অবতীর্ণ বাক্যটি হচ্ছে ‘পড়’ তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ আর তৃতীয় বাক্যে আছে ‘পড় তোমার সম্মানিত প্রভুর নামে, যিনি তোমাদের কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।’ (সূরা আলাক্ব:১-৪)
বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, ‘প্রতিটি মুসলিমের জন্য ইল্ম বা বিদ্যা অর্জন করা ফরজ তথা আবশ্যক। সারারাত ইবাদত-বন্দেগী অপেক্ষা এক ঘন্টা জ্ঞান চর্চা করা উত্তম। যে জ্ঞানীকে সম্মান করে সে যেন আমি (নবী মুহাম্মদ)কে সম্মান করে।’ তাইতো মুহাম্মদ সা. এর জীবদ্দশায়ই আরম্ভ হয়ে পরবর্তীকালে বাগদাদ, মিশরের কায়রো, সালেনা ও কর্ডোভায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠেছে। (দ্রঃ The spirit of islam লেখক: সৈয়দ আমীর আলি, পৃষ্ঠা ৩৬১-৩৬২) আদর্শ বিদ্যানুসন্ধিৎসু দল হিসেবে মুসলিমরা ছিলেন পৃথিবীর উন্নত মার্গে (দ্রঃ History of the Arabs by Philip Hitti পৃষ্ঠা ২৪০, ছাপা ১৯৫১)
মেজর আর্থার গøীন লিনওয়ার্ড বলেন, “আরববাসীদের উচ্চ শিক্ষা সভ্যতা ও মানসিক উৎকর্ষ এবং তাঁদের উচ্চ শিক্ষার প্রণালী প্রবর্তিত না হলে ইউরোপ এখনো অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমগ্ন থাকত। বিজেতার উপর সদ্ব্যবহার ও উদারতা তাঁরা যে প্রকার প্রদর্শন করেছিলেন তা প্রকৃতই চিত্তাকর্ষক।” (দ্রঃ চেপে রাখা ইতিহাস: ১৮)
শ্রী জওহরলাল নেহেরু বলেন, হযরত মুহাম্মদের প্রচলিত ধর্ম, এর সততা, সরলতা, ন্যায়-নিষ্ঠা এবং বৈপ্লবিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সমতা ও ন্যায়নীতি পার্শ্ববর্তী রাজ্যের লোকদের অনুপ্রাণিত করে। কারণ এ সমস্ত রাজ্যের জনসাধারণ দীর্ঘদিন যাবত একদিকে শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক নিপীড়িত, শোষিত ও নির্যাতিত হচ্ছিল অপরদিকে ধর্মীয় ব্যপারে নির্যাতিত নিস্পেষিত হচ্ছিল পোপদের হাতে। (দ্রঃ চেপে রাখা ইতিহাস: ১৯)
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য অভিযোগ করে বলেছেন, ইসলামের শিক্ষা হল-জেহাদ করেপরের সম্পদ ঘরে আনতে হবে। চুরি, ডাকাতিতেই ইসলামের প্রেরণা।
ইসলামে জেহাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সত্য এবং ন্যায়বিচার পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করা, যাতে স্বার্থান্বেষী মহল পার্থিব শান্তি ও নিরাপত্তার বিঘিœত করতে না পারে। যে যুদ্ধের উদ্দেশ্য আদল ও ইনসাফ, আমানত ও সত্যবাদিতার হেফাজত এবং ঘুষ, চুরি, জেনা-ব্যভিচার, দুশ্চরিত্র, নির্লজ্জতা, অপকর্ম এবং স্বীয় হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার মূলোৎপাটন হয় তবে সে যুদ্ধ বর্বরতা নয়; বরং উচ্চাঙ্গের ইবাদত ও আল্লাহ সৃষ্টজীবের উপর অপরিসীম দয়া ও মেহেরবানি। (সীরাতে মুস্তফা (সাঃ), ২য় খন্ড, ৩৭ নং পৃষ্ঠা)
আর চুরি-ডাকাতিকে ইসলাম কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করেছে। উপরন্তু চোর ও ডাকাতের ব্যপারে ইসলাম কঠোর আইন প্রয়োগ করতে নির্দেশ করেছে। আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন,
والسارق والسارقة فاقطعوا أيديهما جزاء بما كسبا نكالا من الله والله عزيز حكيم-
চোর পুরুষ ও নারী উভয়ই হাত কেটে ফেল। তা আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে তাদের কৃতকর্মের শাস্তিস্বরূপ, আল্লাহ তায়ালা প্রবল পরাক্রমশালী, মহান প্রজ্ঞাময়। (৫:৩৩)
চোর পুরুষ হোক কি নারী, তার হাত কেটে ফেল। এ শাস্তি চুরি করা সম্পদের বিনিময়ে নয় বরং চৌর্যবৃত্তির জন্যেই এ শাস্তি যেন চোর এমনি জঘন্য অপরাধ থেকে বিরত থাকে এবং তার দেখাদেখি অন্যরাও এমন নিন্দনীয় কাজ থেকে নিবৃত্ত থাকে। (সূরা মায়েদা: ৩৮) বনূ মাখজুম গোত্রের জনৈকা মহিলা চুরির দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পর রাসূল সা. এর প্রিয়পুত্র সাহাবী উসামা বিন যায়েদ (রাযিঃ) তার দন্ড মওকুফের জন্য সুপারিশ করলে রাসূল (সাঃ) বললেন, শপথ সেই আল্লাহ পাকের; যার হাতে আমার প্রাণ, যদি মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমাও চুরি করতো, তবে আমি তার হাত কেটে দিতাম। (মুসলিম শরীফ, তাফসীরে মাজহারী, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ৪৬৬)
ডাকাতদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
إنما جزاء الذين يحاربون الله ورسوله ويسعون فى الأرض فسادا أن يقتلوا أو يصلبوا أو تقطع أيديهم وأرجلهم من خلاف أو ينفو من الأرض- ذلك لهم خزي فى الدنيا ولهم فى الأخرة عذاب عظيم-
যারা আল্লাহ তায়ালা ও তার রাসূলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং দুনিয়াতে অশান্তি সৃষ্টি করে তাদের শাস্তি এই হবে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা তাদের ফাঁসি দেয়া হবে অথবা তাদের হাত-পা বিপরীতভাবে কেটে দেয়া হবে অথবা তারা সেখান থেকে বিতাড়িত হবে। এ হলো দুনিয়াতে তাদের অপমান এবং আখেরাতে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। (৫:৩৩, তাফসীরে নূরুল কোরআন, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা- ২১২-২১৩)
আলোচ্য আয়াতে ফাসাদ বা অশান্তি সৃষ্টির যে কথা রয়েছে অনেক তাফসীরকারের মতে তার অর্থ হলো- রাহজানি বা ডাকাতি,যা বর্তমান যুগে অহরহ হতে দেখা যায়। পবিত্র কুরআনের আয়াতে এমন অপরাধের শাস্তির কথা ঘোষণা করেছে। যেহেতু ডাকাতদের অবস্থা চার প্রকার হয় তাই শাস্তিও বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন রকম ঘোষণা করা হয়েছে। (প্রাগুক্ত- ২১৫-২১৬)
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য অভিযোগ করে বলেছেন, “ইসলামি মতে ইসলাম হল শ্রেষ্ঠ পথ।”
আমরা বলবো, শুধু ইসলামী মতেই ইসলাম শ্রেষ্ঠ নয় বরং পৃথিবীর যে কোন ধর্মের শিক্ষিত ও বিদ্বান ব্যক্তিদের মত এটি। অধ্যাপক শান্তিভূষণ বসু বলেছেন- ‘পৃথিবীর সর্বাধুনিক ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মের নাম ইসলাম ধর্ম। বহু পÐিতের মতে একমাত্র ইসলাম ধর্মই কার্যকরীভাবে মানুষের মনুষ্যত্ব রক্ষায় তৎপর...” (দ্রঃ চেপে রাখা ইতিহাস: ৩২, ৯ম সংস্করণ ২০১৪ ইং, মাকতাবাতুত তাকওয়া, বাংলাবাজার, ঢাকা)
ভারতীয় নেতা শ্রী করম চাঁদ গান্ধী বলেন, প্রতীচ্য যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রাচ্যের আকাশে তখন উদিত হল এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং আর্ত পৃথিবীকে তা দিল আলো ও স্বস্তি। ইসলাম একটি মিথ্যা ধর্ম নয়। শ্রদ্ধার সাথে হিন্দুরা অধ্যয়ন করুক তাহলেই আমার মত তারা একে ভালবাসবে। (প্রাগুক্ত: ২০)
(ডাঃ কালিদাস বৈদ্যের বই ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব’- এর পিডিএফ কপি ইন্টারনেটে পেতে হলে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব লিখে সার্চ করুন।)
হাফেজ মাওলানা ক্বারী শাহ আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী হুজুর এর
আরজ
নাহমাদুহু ওয়ানুসল্লি ‘আলা রাসূলিহিল কারীম, আম্মাবাদ-
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী ছিল, শেখ মুজিবুুর রহমান কী চেয়েছিলেন, এ বিষয়ে বই লিখতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা দাবীদার ভারতীয় লেখক ডাঃ কালিদাস বৈদ্য “বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব” নামে একটি বই লিখেছেন।
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য তার “বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব” বইয়ে সূরা তাওবার ৫নং আয়াত, সূরা নিসার ৮৯ নং আয়াত, সূরা আনফালের ৩৯ নং আয়াত, সূরা মুহাম্মদের ৪নং আয়াতের অপব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এদেশের মুসলমানরা আল্লাহর হুকুম হিসেবে এই আয়াতগুলি তামীল করতে গিয়ে ত্রিশ লক্ষ হিন্দুকে হত্যা করেছে, হিন্দুদের বাড়ীঘর লুণ্ঠনের পর তা জ্বালিয়ে দিয়েছে, হিন্দু নারীদের নির্যাতনের পর ধর্ষণ করেছে - যা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ হিন্দু হত্যা হয়নি, পবিত্র কুরআনের আয়াতের দোহাই দিয়ে কোন হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করা হয়নি বা হিন্দুদের বাড়ীঘর লুণ্ঠনের পর তা জ্বালিয়ে দেয়া হয়নি। এসব কাজ ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম। কোরআনের আয়াত ১৯৭১ সালে হিন্দুদের হত্যা, তাদের বাড়ীঘর লুণ্ঠন বা হিন্দু নারীদের ধর্ষণের জন্য নাযিল হয়নি।
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য তার “বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব” বইয়ের ৫৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ... ‘শিক্ষাদীক্ষায় মুসলমানদের অনীহার কারণও ইসলামের শিক্ষা। শিক্ষাদীক্ষা ও নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত সৎ মানুষ গড়ার কোনো প্রেরণা ইসলামে নেই। ইসলাম মানুষকে সম্পদ সৃষ্টিতে কোন প্রেরণা যোগায় না। ইসলামের শিক্ষা হল জেহাদ করে পরের সম্পদ ঘরে আনতে হবে। চুরি, ডাকাতিতেই ইসলামের প্রেরণা। ইসলামি মতে ইসলাম হল শ্রেষ্ঠ পথ। এই পথের পথিক বলে একজন মুসলমান পাহাড় প্রমাণ পাপ করলেও সৃষ্টিকর্তার ক্ষমা পাবে। পরলোকে জান্নাত (স্বর্গ) বাসী হবে।”
বইয়ের ৫৫ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, “জেহাদের সারকথা হল, বিধর্মীদের আক্রমণ কর, খুন কর, শূলবিদ্ধ কর, হাত পা কেটে দাও। তবে মুসলমান হতে রাজি হলে ক্ষমা করে দিও। অন্যথায় তাদের ঘর বাড়ি লুট কর, জ্বালিয়ে দাও। তাদের মেয়েদের উপর অত্যাচার চালাও। এইভাবে এক ভয়াবহ সন্ত্রাসের পরিস্থিতি তৈরি কর, যা দেখে বা শুনে অন্যরা ভয় পেয়ে মুসলমান হয়।”
ডাঃ কালিদাস বৈদ্যের “বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব” বইয়ের কারণে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট, সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা রাজনৈতিক স্থীতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। বইটি নিজ দায়িত্বে সংগ্রহ করে প্রত্যেক বিবেকবান মানুুুুুুষের পড়া উচিৎ। বিশেষকরে প্রধানমন্ত্রীর নিজেরও পড়া উচিৎ, মন্ত্রী পরিষদের সকল সদস্যবৃন্দ ও জাতীয় সংসদের সকল সংসদ সদস্যদের পড়া উচিৎ এবং সরকারকে এর একটি সুন্দর সহনশীল সঠিক জবাব দেয়া উচিৎ। মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধসহ সকল সম্প্রদায়ের লোক ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করার জন্য সভা সমাবেশ, মিছিল, আলোচনা সভা, সেমিনার, সেম্পুজিয়ামসহ সবধরনের প্রচেষ্টা চালানো উচিৎ। কারণ বইয়ের বক্তব্য নিয়ে ইদানিংকালে পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশনের টকশো, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, ফেইসবুকসহ সব গণমাধ্যমে ব্যপক আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে।
“আমরা মহান জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্যদের প্রতি আহবান করছি তারা ডাঃ কালিদাস বৈদ্যের বই “বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব” এ পবিত্র কুরআনের আয়াতের অপব্যাখ্যা করে এবং মহান স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিয়ে মিথ্যাচারের জন্য বিষয়টি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করবেন, আলোচনা করবেন এবং নিন্দা প্রস্তাব গ্রহন করবেন”।
ডাঃ কালিদাস বৈদ্যের বই ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব’ এর পাতায় পাতায় হিংসা-বিদ্বেষ ঘৃণা ছড়ানো মিথ্যা আপত্তিকর ও স্পর্শকাতর বক্তব্য আছে। বাংলাদেশের মুসলমানদেরকে ঘৃণ্য নিকৃষ্ট ও ধিকৃত করার এমন কোন বক্তব্য নেই যা ডাঃ কালিদাস বৈদ্য তার বইয়ে করেননি। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুসহ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে অনেক আপত্তিকর ও স্পর্শকাতর বক্তব্য আছে, যা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। বাংলাদেশ মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সকলের। আমরা সবাই ভাই ভাই, সকলে মিলে মিশে এদেশে থাকতে চাই। আমাদের মাঝে এই বইয়ে পবিত্র কোরআন মজীদের আয়াতের অপব্যাখ্যার দ্বারা কোনরূপ রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি না হয়, এজন্য বাংলাদেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, মসজিদের ইমাম-খতীব, ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলির নেতাকর্মীসহ প্রত্যেক মুসলমানের উচিৎ ও ঈমানী দায়িত্ব হচ্ছে, কোরআন মজীদের এই আয়াতগুলির অপব্যাখ্যার দ্বারা যাতে কোনরূপ বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়, সেজন্য প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থানে জুম‘আর বয়ানে, ওয়াজ মাহফিলে অপব্যাখ্যাকৃত আয়াতগুলির সঠিক ব্যখ্যা তুলে ধরে জনগণকে সচেতন করা।
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য কর্তৃককুরআনের ওপর অপবাদ
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য লিখিত ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব’নামক বইয়ের ‘লেখকের কথা’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন-
“ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কোরাণে আমরা দেখতে পাই “... অংশীবাদীদের যেখানে পাবে হত্যা করবে, তাদের বন্দী করবে। অবরোধ করবে এবং প্রত্যেক ঘাটিতে তাদের জন্য ওৎ পেতে থাকবে কিন্তু যদি তারা তওবা করে, নামাজ কায়েম করে, যাকাত দেয়, তবে তাদের পথ মুক্ত করে দেবে” (৯/৫) --- তাদের গ্রেপ্তার করবে, যেখানে পাও হত্যা কর, এবং তাদের সাথে বন্ধুত্ব কর না- (৪/৮৯).. “তাদের সাথে অবিরাম যুদ্ধ কর যতক্ষণ না আল্লার রাজত্ব কায়েম হয় (৮/৩৯) ... তাদের গর্দানে আঘাত কর (৪৭/৪) .... তাদের হাত, পা কেটে ফেল, শূল বিদ্ধ কর ও হত্যা কর” ইত্যাদি ভিন্নধর্মী বা অমুসলমানদের খতম করতে আল্লা নিজেই এরূপ অনেক নির্মম আদেশ দিয়েছেন। আমরা দেখতে পাই, ৯/৫ নং আয়াতে সন্ত্রাসবাদের নির্দেশ আছে। সেই সন্ত্রাসবাদ আজ আত্মঘাতী সন্ত্রাসবাদের রূপ নিয়েছে। ”
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য কর্তৃক কুরআনের উপর আরোপিতঅপবাদের জবাব
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য কুরআনুল কারীমের উপরোক্ত ৪টি আয়াতের মাধ্যমে ‘মহান আল্লাহকে সন্ত্রাসবাদের নির্মম নির্দেশদাতা এবং কুরআনে সন্ত্রাসবাদের নির্দেশ আছে’ এমনটি দাবী করেছেন। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হলো- কুরআনুল কারীমের কোন আয়াত ও তার হুকুম বুঝতে হলে পূর্বাপরের আয়াত, অবতীর্ণের প্রেক্ষিত, অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে অবগতি থাকা অত্যাবশ্যকীয়। অন্যথায় কুরআনের কোন আয়াতের হুকুম, ব্যাখ্যা বা মর্ম বুঝা সম্ভব নয়। অথচ ডাঃ কালিদাস বৈদ্য মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী প্রমাণ করতে সকলের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর ব্যপারে কথা বলতে দ্বিধা করেননি। আয়াতের অপব্যখ্যা করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানী দিচ্ছেন। পারস্পরিক সহাবস্থান, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বিনষ্টের সুগভীর চক্রান্তের বীজ বপন করছেন।
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য উত্থাপিত ৪টি আয়াতের বিধি-বিধান, প্রেক্ষাপট ইত্যাদি নিম্নে উল্লেখ করা হলো
প্রথম আয়াত: সূরা নিসা, ৮৯ নং আয়াত।
فَإِن تَوَلَّوْاْ فَخُذُوهُمْ وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ وَجَدتَّمُوهُمْ- سورة النساء- ৮৯
আয়াতের তরজমা
তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় (আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে হিজরত না করে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত অব্যাহত রাখে) তাহলে তাদেরকে পাকড়াও কর এবং যেখানে পাও হত্যা কর।
আয়াতের শানে নুযূল ও তাফসীর
আলোচ্য আয়াতটি এবং তাতে বর্ণিত হুকুম নাজিল হয়েছিল মুনাফিকদের ক্ষেত্রে। আল্লাহর নির্দেশে মুহাম্মদ (সাঃ)যখন হিজরত করে মদীনায় চলে যান, তখন মুসলমানদের জন্য হিজরত করা ততটাই আবশ্যক ছিল- যতটা আবশ্যক ছিল ইসলামের জন্য কালিমায়ে শাহাদাতের সাক্ষ্য দেয়া। কিন্তু মক্কায় তখন এমন কিছু মুনাফিক ছিল, যারা মদীনায় গিয়ে বিশ্বনবী সা. ও সাহাবীদের সামনে নিজেদের ঈমান যাহির করতো আর মক্কায় ফিরে এসে মুশরিকদের সাহায্য করতো এবং কীভাবে মুসলমানদের ক্ষতি সাধন করা যায় সে চক্রান্ত করতো। তাই আল্লাহ তায়ালা সে সকল মুনাফিকের ব্যপারে হুকুম নাযিল করলেন-
فَإِن تَوَلَّوْاْ فَخُذُوهُمْ وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ وَجَدتَّمُوهُمْ- - سورة النساء- ৮৯
অর্থাৎ তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় (আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে হিজরত না করে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত অব্যাহত রাখে) তাহলে তাদেরকে পাকড়াও কর এবং যেখানে পাও হত্যা কর।
আল্লাহ তায়ালা এই হুকুম নাযিল করার পাশাপাশি তাদের মুক্তির পথও দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তবে এ সকল মুনাফিকের মুক্তির জন্য দুটি পথ রয়েছে, যথা-
---।১। إِلاَّ الَّذِينَ يَصِلُونَ إِلَىَ قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُم مِّيثَاقٌ--।২أَوْ جَآؤُوكُمْ حَصِرَتْ صُدُورُهُمْ أَن يُقَاتِلُوكُمْ أَوْ يُقَاتِلُواْ قَوْمَهُمْ
১. তবে যারা সে গোত্রের সাথে মিলিত হবে যাদের সাথে তোমাদের সন্ধিচুক্তি রয়েছে।
২. অথবা তারা সরাসরি তোমাদের কাছে এ অবস্থায় আসবে যে, তাদের অন্তর তোমাদের সাথে এবং তাদের স্বজাতির সাথে যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক।
এতএব, আয়াতে কারীমার মূল শিক্ষা এবং নির্দেশনা হল, যদি তারা যুদ্ধ এবং চক্রান্ত থেকে নিবৃত্ত হয়, তাহলে তোমরা তাদেরকে হত্যা করো না। যেমন আল্লাহ তায়ালা পরবর্তী আয়াতে আরো সুস্পষ্টভাবে বলেছেন-
فَإِنِ اعْتَزَلُوكُمْ فَلَمْ يُقَاتِلُوكُمْ وَأَلْقَوْاْ إِلَيْكُمُ السَّلَمَ فَمَا جَعَلَ اللَّهُ لَكُمْ عَلَيْهِمْ سَبِيلاً - النساء(৯০)
সুতরাং তারা যদি তোমাদের থেকে নির্লিপ্ত হয় এবং তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে ও তোমাদের কাছে সন্ধির প্রস্তাব পেশ করে তবে আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে তাদের বিরুদ্ধে (যুদ্ধ করার) কোন সুযোগ রাখেননি। (৪:৯০)খ্যাতিমান মুফাসসির আল্লামা রাযী রহ. এ আয়াতের তাফসীরে লিখেন-
وهذا يدل على أن السبب الموجب لترك التعرض لهم هو تركهم للقتال- التفسير الكبير- ج ১০- ص- ২২৯)
এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, কোন বিধর্মী মুসলমানদের ওপরে আক্রমন না করলে তাদেরকে আক্রমন করার সুযোগ নেই।
* অতএব, আয়াতের সঠিক তাফসীর জানার পর আমরা নির্দ্ধিধায় বলতে পারি, বর্তমান জামানায় ইসলাম ও মুসলমানের যে সকল দুশমন কুরআনুল কারীমের উক্ত আয়াতের ভুল ব্যখ্যা করে ইসলাম ও মুসলমানদের সন্ত্রাসী সাব্যস্ত করতে চায়, মুসলমানদের নামে অপবাদ রটায় এবং নিজেদের দাবীর স্বপক্ষে উক্ত আয়াতে কারীমাকে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করে, তারা মূলত নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনে ধূম্রজাল সৃষ্টি করছে। তারা বর্ণিত আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াত বাদ দিয়ে লাফ দিয়ে এই আয়াতে চলে আসে, আবার এর পরবর্তী আয়াত; যাতে সুন্দর সমাধান রয়েছে সেটাও উল্লেখ করে না।
অতএব,আয়াতের পূর্বাপরের দিকে লক্ষ করলে যায়, এসব তাদের অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ফসল বৈ কিছুই নয়। তেমনি এ কথাও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই আয়াত এবং তাতে বর্ণিত হুকুম আজ থেকে চৌদ্দশত বছর পূর্বের মুনাফিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এর সাথে ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কোন সম্পর্ক নেই। মুক্তিযুদ্ধের সাথে এই আয়াতকে সম্পৃক্ত করা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
দ্বিতীয় আয়াত: সূরা তাওবার ৫ নং আয়াত
فَإِذَا انسَلَخَ الأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُواْ الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدتُّمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُواْ لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ الصَّلاَةَ وَآتَوُاْ الزَّكَاةَ فَخَلُّواْ سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ (৫) التوبة
আয়াতের তরজমা
অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদের হত্যা কর যেখানে তাদেরকে পাও, তাদের বন্দী কর এবং অবরোধ করো। আর প্রত্যেকটি ঘাটিতে তাদের সন্ধানে ওঁৎ পেতে থাক। তবে তারা যদি তাওবা করে নামায কায়েম করে যাকাত আদায় করে তবে তাদেরকে পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সূরা তওবা; ৫)
আয়াতের শানে নুযূল ও তাফসীর
روي أن النبي صلى الله عليه وسلم لما خرج إلى غزوة تبوك وتخلف المنافقون وأرجفوا بالأزاجيف جعل المشركون ينقضون العهد فنبذ النبي عليه السلام العهد اليهم-
নবী করীম সা. মক্কার থেকে হিজরত করে মদিনায় চলে যাওয়ার পর যখন ইসলাম ও মুসলমানগণের ভিত্তি কিছুটা মজবুত হল তখন নবী সা. মক্কার কোন কোন মুশরিক গোত্রের সাথে সন্ধি-চুক্তি করলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই কয়েকটি গোত্র চুক্তি ভঙ্গ করল, বনু বকর যাদের অন্যতম। তাই যেহেতু তারা সন্ধিচুক্তি রক্ষা করেনি, এজন্য আল্লাহ তায়ালাও মুসলমানদেরকে তাদের সাথে সন্ধিমুক্তির চূড়ান্ত ঘোষণা সম্বলিত আয়াত অবতীর্ণ করেন এবং সন্ধি ভঙ্গের শাস্তি বর্ণনা করেন।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা বুঝা যায়, আয়াতে প্রদত্ত হত্যা এবং অন্যান্য হুকুম সমূহ প্রযোজ্য হবে ঐ সকল মুশরিকদের ক্ষেত্রে, যারা নিজেদেরকৃত সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে। একটু ভাবুন তো, কেউ সন্ধিচুক্তি করে তা ভঙ্গ করলে, তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া কি অন্যায়?
দুঃখজনক কথা হলো, ইসলামের দুশমনরা উক্ত আয়াতে কারীমাকেও নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য ব্যবহার করার চেষ্টা করে। তারা আয়াত নাজিল হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবগত নয় অথচপবিত্র কুরআনের কোন আয়াতের হুকুম যথার্থ বুঝার জন্য নিয়ম হলো, সে আয়াতটির প্রেক্ষাপটের প্রতি লক্ষ্য করা। তেমনি তারা পূর্বাপরের আয়াতগুলোর প্রতিও লক্ষ্য করে না, যেখানে এ জাতীয় বিভিন্ন প্রশ্নের সুস্পষ্ট সমাধান রয়েছে । যেমন উক্ত আয়াতের পূর্বের আয়াতে বলা হয়েছে-
إِلاَّ الَّذِينَ عَاهَدتُّم مِّنَ الْمُشْرِكِينَ ثُمَّ لَمْ يَنقُصُوكُمْ شَيْئًا وَلَمْ يُظَاهِرُواْ عَلَيْكُمْ أَحَدًا فَأَتِمُّواْ إِلَيْهِمْ عَهْدَهُمْ إِلَى مُدَّتِهِمْ
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ (৪) التوبة
যাতে চুক্তি রক্ষাকারী মুশরিক এবং যে সকল মুশরিক মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য না করবে, তাদের সাথে প্রতিশ্রæতি রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আবার পরবর্তী আয়াত যাতে সুস্পষ্টই মুশরিকদের মুক্তির পথ এবং তাদেরকে নিরাপদ স্থানে পৌছে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَإِنْ أَحَدٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّى يَسْمَعَ كَلاَمَ اللَّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لاَّ يَعْلَمُونَ (৬)
আর যদি মুশরিকদের কেউ আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে তবে তাকে আশ্রয় দিন। যেন সে আল্লাহর বাণী শুনে নেয়। অতপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌছে দিন। (এ বিধান) এজন্য যে, তারা এমন সম্প্রদায় যারা (কিছুই) জানে না। সূরা তওবা; ৬।
আয়াতের তাফসীরে প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা রাযী রহ. লিখেন-
نقل عن ابن عباس أنه قال : إن رجلا من المشركين قال لعلي بن أبي طالب : إن أردنا أن نأتي الرسول بعد انقضاء هذا الأجل لسماع كلام الله أو لحاجة أخرى فهل نقتل ؟ فقال علي : "لا" إن الله تعالى قال :( وإن أحد من المشركين استجارك فأجره ) أي فأمنه حتى يسمع كلام الله-
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক মুশরিক হযরত আলী রাযি. কে বললেন, আমরা যদি চুক্তি শেষ হওয়ার পরে আল্লাহর বাণী শুনতে বা অন্য কোন প্রয়োজনে নবীর নিকট আসতে চাই তবে কি আমাদেরকে হত্যা করা হবে? তখন হযরত আলী (রাযিঃ) বললেন, না । (হত্যা করা হবে না।) কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যদি মুশরিকদের কেউ আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে তবে তাকে আশ্রয় দিন। যেন সে আল্লাহর বাণী শুনে নেয়। অতপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌছে দিন । (সূরা তওবা: ৬)
অতএব আয়াতে কারীমার পূর্বের চার নম্বর আয়াত এবং পরবর্তী ছয় নম্বর আয়াতে পাঁচ নম্বর আয়াতে বর্ণিত মূল হুকুমের সঠিক ক্ষেত্র বলে দেয়া হয়েছে এবং এটাই আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনা। এতে কোন নির্দোষ মুশরিককে যেখানে সেখানে হত্যা করতে বলা হয়নি বরং যদি মুশরিক মুসলমানদের আশ্রয়ে আসে ইসলাম গ্রহণ না করলেও তাকে নিরাপদ স্থানে পৌছে দেয়া মুসলমানদের ওপর আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত দায়িত্বআর যদি ইসলাম মেনে নেয় তাহলে তো তারা আমাদের ভাই।
অথচ ডাঃ কালিদাস বৈদ্য৪ নম্বর আয়াত না দেখে, না বুঝে৫ নম্বার আয়াত নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি করছেনএবং পরবর্তী আয়াতগুলো যেখানে সমাধান রয়েছে সেগুলো না দেখার ভান করে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, ইসলাম কোন নির্দোষ মানুষকে হত্যা করতে সমর্থন করে না। উপরন্তু ইসলাম নির্দোষ মানুষ হত্যা করাকে কঠোরভাবে অনুৎসাহিত করেছে।পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ হচ্ছে-
مَن قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا- سورة المائدة- ৩২
যে ব্যক্তি কোন প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ বা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করল এবং যে ব্যক্তি কারো জীবন রক্ষা করল, সে যেন সমগ্র মানব জাতিকে রক্ষা করল। (৫; ৩২)
আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষিত
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে এমন সম্প্রদায়ের ব্যপারে, যারা মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে যাহির করত আর গোপনে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের সহযোগিতা করতো, এ কারণে মুসলমানগণ তাদের ব্যপারে মতানৈক্যে পড়ে গেলেন এবং বিতর্ক করতে লাগলেন, তারপরেই আয়াতটি অবতীর্ণ হল। (তাফসীরে মুনীর: খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-১৯৯)
যে সকল মুনাফিকদের ব্যপারে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল, তারা হল- আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার সাথীবর্গ। যারা উহুদের যুদ্ধের দিন নবী সা.কে ময়দানে রেখে সাথীদেরকে নিয়ে পালিয়েছিল।
আয়াতের হুকুম:
মুনাফিকদের বন্দি করা এবং হত্যা করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়’ অর্থাৎ যদি তারা আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য দেয়া এবং হিজরত করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তাদেরকে বন্দি এবং হত্যা কর যেখানে পাও।
আল্লামা শারাভী (রহঃ) স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে লেখেন, আয়াতে একটি সন্ধিচুক্তির বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যা রাসূল সা. কোন কোন আরব্য গোত্রের সাথে করেছিলেন আর এ সকল চুক্তি স্বীকৃতি দেয় যে, নবী করীম সা. গোত্রগুলোর সাথে এই মর্মে চুক্তি করেছিলেন যে, তারা মুসলমানদের উপর আক্রমন করবে না এবং মুসলমানরাও তাদের উপর আক্রমন করবে না।
আল্লামা আলুসী রহ. তাফসীরে রুহুল মা’আনী তে বলেছেন- আল্লাহর বাণী فَإِن تَوَلَّوْاْ অর্থাৎ যদি তারা আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে মসজিদে হারামের ভিতরে/বাইরে যেখানে তাদেরকে পাও বন্দী কর এবং হত্যা কর।
তবে হে মুসলমান সম্প্রদায়, আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ (হত্যা এবং বন্দির এই নির্দেশ) যখন তখন ব্যাপকভাবে সবসময়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ ইসলাম হল অঙ্গীকার রক্ষাকারী দ্বীন আর তোমরাতো কতিপয় গোত্রকে অঙ্গীকার প্রদান করেছো যে, তাদের কেউ মুসলমানদের আশ্রয়ে এলে অনুরূপ কেউ মুসলমান হয়ে তাদের কাছে গেলে তাদের দায়িত্ব হল, তার হেফাজত করা এবং তার উপর যেকোন বাড়াবাড়ি প্রতিহত করা। আর এজন্যই আল্লাহ তায়ালা আয়াতের শেষে মূল বিধানের ব্যতিক্রম করে বলেছেন- إِلاَّ الَّذِينَ يَصِلُونَ তবে যারা এমন গোত্রে গিয়ে পৌছবে যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে তারা নিরাপদ। (সূরা নিসা- ৯০)
আল্লমা ফখরুদ্দীন রাযী (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
فَإِن تَوَلَّوْاْ فَخُذُوهُمْ وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ وَجَدتَّمُوهُمْ- - سورة النساء- ৮৯
আয়াতের উদ্দেশ্য হল, যদি তারা হিজরত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং মদিনার বাইরে তাদের অবস্থান নির্দিষ্ট করে নেয়, তাহলে যখন তোমরা তাদের পাও, যেখানেই পাও, হত্যা কর আর এ অবস্থায় কিছুতেই তাদের কাউকে এমন বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যে তোমাদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আঞ্জাম দিবে এবং সাহায্যকারী রূপেও গ্রহণ করো না, যে শত্রæর বিরুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করবে। জেনে রাখুন, যখন আল্লাহ তায়ালা হত্যার নির্দেশ দিলেন, তখন এই নির্দেশ থেকে দুই প্রকার লোককে আলাদা রেখেছেন।
১। إِلاَّ الَّذِينَ يَصِلُونَ তবে যারা এমন গোত্রের সাথে মিলিত হবে যাদের মাঝে এবং তোমাদের মাঝে সন্ধি চুক্তি বিদ্যমান।
২। أَوْ جَآؤُوكُمْ حَصِرَتْ صُدُورُهُمْ অথবা যারা এই এই প্রতিজ্ঞা করে তোমাদের কাছে এসেছে যে, তারা তোমাদের সাথে এবং স্বীয় গোত্রের সাথে যুদ্ধ করবে না। (তাফসীরে কাবীর: ১০/ ২২৮)
আল্লামা শাহ আশরাফ আলী থানবী রহ. বয়ানুল কুরআনে বলেন- সে সময় হিজরতের ঐ হুকুম ছিল, যেই হুকুম বর্তমানে মুসলমানদের জন্য কালিমায়ে শাহাদাতের সাক্ষ্য দেওয়া।
আব্দুল্লাই ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। একজন মুশরিক হযরত আলী রাযি.কে বললো, হে আলী! আমরা যদি উক্ত দিনগুলি অতিবাহিত হওয়ার পর রাসূল সা. এর কাছে কুরআন শ্রবণ বা অন্য কোন প্রয়োজনে আসতে চাই তাহলে আমাদেরকে কি হত্যা করা হবে? তখন আলী রাযি. বললেন, না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, وَإِنْ أَحَدٌ মুশরিকদের কেউ যদি তোমাদের আশ্রয় প্রার্থনা করে তাহলে তাদের আশ্রয় দাও। যাতে সে আল্লাহর বাণী শ্রবণ করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, আয়াতের উদ্দেশ্য হল, এ কথা ব্যক্ত করা যে, যখন কোন বিধর্মী ইসলামের ব্যপারে কোন দলীল-প্রমাণ জানতে চায় বা কুরআনের বাণী শ্রবন করতে চায় তাহলে তাকে সুযোগ দেয়া ওয়াজিব। তাকে হত্যা করা হারাম এবং নিরাপদ স্থানে তাকে পৌছে দেয়া। (তাফসীরে রাযী: ১৫/২৩৫)
আল্লামা সাইয়েদ কুতুব (রহঃ)তাফসীর ফী যিলালীল কুরআনে বলেন, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মুশরিকদেরকে নির্দিষ্ট চার মাস অতিবাহিত হওয়ার পরে পূর্ণরূপে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেওয়াটা ইসলাম ধর্মের উদার দৃষ্টিভঙ্গি। তার উত্তমতা এবং বাস্তবমূখী হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করে। অনুরূপ উক্ত আয়াতে সকল মুশরিককে হত্যা বা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলা হয়নি। যেমনটি অনেকে বলে থাকে।
অতএব, কোন মুশরিক (যাকে জাহিলী কোন অজ্ঞতা গ্রাস করেনি) সে যদি ইসলামের জন্য নিজেকে পেশ করে এবং ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয় তাহলে ইসলাম তাদেরকে ইসলামী রাষ্ট্রে পূর্ণ নিরাপত্তার ভার প্রদান করে আর আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা.কে নির্দেশ দিয়েছেন,তিনি যেন মুশরিকদের আল্লাহর কালাম শ্রবণ এবং দ্বীনী দাওয়াত পরিপূর্ণরূপে তাৎপর্য সহকারে জানারসুযোগ করে দেন এবং তাদেরকে নিরাপদ স্থানে পৌছে দেওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা প্রদান করতে। এ সকল উদারতা ও নিরাপত্তা প্রদানের নির্দেশ ঐ সময়ের জন্য প্রযোজ্য হবে, যখন (وَإِنْ أَحَدٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ)মুশরিকদের কেউ তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করে। যদি আশ্রয় চায় তবে তাকে আশ্রয় দাও। (তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন)
সূরা আনফালের ৩৯ নং আয়াত:
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلّه فَإِنِ انتَهَوْاْ فَإِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ بَصِيرٌ (৩৯)
আয়াতের তরজমা:
আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক, যতক্ষণ না ফিতনা শেষ হয়ে যায় এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হয়ে যায়।
আয়াতের তাফসীর:
বর্ণিত আয়াতে কারীমাকে ইসলামের দুশমনরা বিকৃতভাবে মানুষের সামনে প্রচার করে বেড়ায় আর সকলের কাছে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী বলে চিত্রায়িত করতে চায়। অথচ উক্ত আয়াতের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী আয়াত সমূহ অধ্যয়ণ করলে তাদের উত্থাপিত এ অসার দাবী এবং সর্বপ্রকার সংশয় দূরীভূত হয়ে যায়। পাঠক, একটু মনোযোগ দিয়ে পূর্বাপর আয়াতগুলো লক্ষ্য করুন। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَمَا لَهُمْ أَلاَّ يُعَذِّبَهُمُ اللَّهُ وَهُمْ يَصُدُّونَ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَمَا كَانُواْ أَوْلِيَاءهُ إِنْ أَوْلِيَآؤُهُ إِلاَّ الْمُتَّقُونَ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ (৩৪)
(তরজমা) আর তাদের কী বা গুণ আছে যে, আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন না অথচ তারা মানুষকে মসজিদুল হারামে যেতে বাধা দেয়, যদিও তারা তার রক্ষক নয়। মুত্তাকীগণ ছাড়া অন্য কোনও লোক তার রক্ষক হতেই পারে না। কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোক (এ কথা) জানে না। (সূরা আনফাল: আয়াত- ৩৪)
وَمَا كَانَ صَلاَتُهُمْ عِندَ الْبَيْتِ إِلاَّ مُكَاءوَتَصْدِيَةً فَذُوقُواْ الْعَذَابَ بِمَا كُنتُمْ تَكْفُرُونَ (৩৫)
(তরজমা) বাইতুল্লাহর নিকট তাদের নামায শিশ দেয়া ও তালি বাজানো ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং তোমরা যে কুফরী কাজকর্ম করতে, তজ্জন্য এখন শাস্তি ভোগ কর। (সূরা আনফাল: আয়াত- ৩৫)
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُواْ يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ لِيَصُدُّواْ عَن سَبِيلِ اللَّهِ فَسَيُنفِقُونَهَا ثُمَّ تَكُونُ عَلَيْهِمْ حَسْرَةً ثُمَّ يُغْلَبُونَ وَالَّذِينَ كَفَرُواْ إِلَى جَهَنَّمَ يُحْشَرُونَ (৩৬)
অর্থ: যারা কুফর অবলম্বন করেছে, তারা আল্লাহর পথে মানুষকে বাঁধা দেওয়ার জন্য নিজেদের অর্থ সম্পদ ব্যয় করে।
قُل لِلَّذِينَ كَفَرُواْ إِن يَنتَهُواْ يُغَفَرْ لَهُم مَّا قَدْ سَلَفَ وَإِنْ يَعُودُواْ فَقَدْ مَضَتْ سُنَّةُ الأَوَّلِينِ (৩৮)
(তরজমা) হে নবী! যারা কুফর অবলম্বন করেছে, তাদেরকে বলে দাও তারা যদি নিবৃত্ত হয় তবে অতীতে যা কিছু হয়েছে তা ক্ষমা করে দেওয়া হবে। কিন্তু তারা যদি পুনরায় সে কাজই করে তবে পূর্ববর্তী লোকদের সাথে যে আচরণ করা হয়েছে তা তো (তাদের সামনে) রয়েছেই।
লক্ষ করুন, পূর্বের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের অন্যায় কাজের কথা উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ কাফেররা মুসলমানদেরকে তাদের প্রাণকেন্দ্র মসজিদুল হারামে প্রবেশের অধিকার থেকে বাঁধা প্রদান করত। তারপর আল্লাহ তায়ালা নবী (সাঃ) কে পূর্ববর্তী উম্মতদের বাড়াবাড়ির কারণে তাদের যে পরিণতি হয়েছিল তা উল্লেখ করে ভীতি প্রদর্শনের নির্দেশ দেন। তা হল, যখনি পূর্ববর্তী উম্মতগণের মাঝে কোন নবী আসতেন এবং তাদের উম্মতেরা যদি তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করত তখন সে নবী তাদের উপর আল্লাহ তায়ালার আযাবের কামনা করতেন। এরপরে তারা যদি এরূপ অন্যায় থেকে কোনক্রমেই নিবৃত্ত না হয় তখন আপন হক্ব আদায়ের জন্য তাদের সাথে যুদ্ধ করতে নির্দেশ প্রদান করেন। যাতে মসজিদুল হারাম কাফেরদের হাত থেকে মুক্ত হয় এবং তাতে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করা হয়। আর এভাবেই দ্বীন পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়। কারণ কাফেররা তখন কাবার পার্শ্বে বহু মূর্তিও স্থাপন করেছিল এবং পূঁজা করত।
অতএব উল্লেখিত বিবরণে এ কথা স্পষ্ট হল যে, এ সকল আয়াতে ঐ সকল কাফেরদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, যারা ইসলামের ক্ষতি-সাধনের জন্য তাদের অর্থ ব্যয় করত, মুসলমানদেরকে তাদের মসজিদে প্রবেশে বাঁধা দান করত- এমন ক্ষেত্রে তাদের সাথে যুদ্ধ করা মুসলমানদের জন্য আবশ্যক হয়ে পড়ে।
এখানে সাধারণ বিধর্মীদের ব্যপারে বলা হয়নি। বরং যারা সন্ত্রাসী বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী তাদের বিরুদ্ধে বলা হয়েছে। সন্ত্রাসী যেই হোক তাকে প্রতিহত করতে কে না বলে? হ্যাঁ, তারা যদি আগেই এ ধরণের অন্যায় কাজ থেকে নিবৃত্ত হয় তাহলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে এবং পূর্বের কৃত অপরাধও মাফ করে দেওয়া হবে। বরং কত উদার নীতির কথাই না বলা হল অথচ ডাঃ কালিদাস বৈদ্য ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কুরআনকে সন্ত্রাসের উস্কানীদাতা বলে নির্লজ্জ মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালা উক্ত আয়াতে কোন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা বা কারো বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দেননি। বরং কারো অপরাধ প্রমাণিত হলে মানব জাতির কল্যাণেই এ বিধানটি দিয়েছেন। আপনি জেনে থাকবেন যে, নিরপরাধ মানুষকে হত্যার ব্যপারে ইসলাম বড় কঠোর।পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করাকে গোটা মানবজাতিকে হত্যার নামান্তর বলে ঘোষণা দিয়েছেন বিপরীতে একজন মানুষের প্রাণ রক্ষা করাকে গোটা মানব প্রাণ রক্ষা করারশামিল বলে ব্যক্ত করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
مَن قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا- سورة المائدة- ৩২
যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টির কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করল, সে যেন সকল মানুষকেই হত্যা করল এবং যে কারো জীবন রক্ষা করল, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করল। (৫: ৩২) আশাকরি, পূর্বাপরের আয়াত এবং নিরপরাধ মানুষ হত্যার ব্যপারে কুরআনের কঠোর অবস্থানের বিষয়টি জানার মাধ্যমে আপনার মনের সৃষ্ট প্রশ্নের সমাধান পাওয়া গেছে।
সূরা মুহাম্মদের ৪ নং আয়াত
আল্লাহ তায়ালা বলেন-
فَإِذا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتَّىإِذَا أَثْخَنتُمُوهُمْ فَشُدُّوا الْوَثَاقَ فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاء حَتَّى تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا ذَلِكَ وَلَوْ يَشَاء اللَّهُ لانتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍ وَالَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَلَن يُضِلَّ أَعْمَالَهُمْ (৪)
আয়াতের তরজমা:
অতঃপর যখন তোমরা কাফেরদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও তখন তাদের গর্দানে মার, অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাভূত কর তখন তাদেরকে শক্ত করে বেধে ফেল। অতঃপর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, না হয় তাদের নিকট হতে মুক্তিপণ লও। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে যে পর্যন্ত না শত্রু পক্ষ অস্ত্র সমর্পন করবে। তোমাদের প্রতি এটাই নির্দেশ। আল্লাহ চাইলে নিজেই তাদেরকে শাস্তি দিতেন কিন্তু তিনি তোমাদের একজনকে অপরের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান। আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, আল্লাহ কখনই তাদের কর্মফল নিস্ফল করবেন না। (সূরা মুহাম্মদ-৪)
উক্ত আয়াতে কারিমার প্রেক্ষাপটের প্রতি লক্ষ্য না করে কেবল বাহ্যিক অবস্থার বিবেচনায় ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমনরামুসলমানদেরকে এ বলে অপবাদ দেয় যে, আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে যখনি কোন মুশরিকদের সাথে যে কোন স্থানে সাক্ষাত হয় তাদেরকে কোন অপরাধ ব্যতিত হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আয়াতের তাফসীর:
আয়াতের প্রতি লক্ষ্য করুন। এখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনحَتَّى تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا যতক্ষণ না শক্রপক্ষ অস্ত্র সমর্পণ করবে। অর্থাৎ আয়াতটি মূলত যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রæপক্ষ যখন অস্ত্র নিয়ে আক্রমন বা হত্যা করছে, সে সময় সংক্রান্ত। যুদ্ধ চলাকালীন একজন সৈনিকের ভূমিকা কী হবে, সে ব্যপারে এখানে নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। এটা স্বাভাবিক সময়ের বিষয় নয়। আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ওয়াহবাতুয যুহাইলী রহ. তাফসীরে মুনীরে লেখেন-
وذلك حتى لا يكون حرب مع الكفار ولا قتال ، بأن يضع الأعداء المحاربون أوزارهم ، وهو سلاحهم بالهزيمة أو الموادعة ، أي إن غاية هذه الأوامر إنهاء الحرب والقتال. وهذا في الحقيقة حث على السلم المستتب ، ليعيش الناس في سلام وأمان ، ويتم تبادل الأفكار ، وتنتشر دعوة الإسلام بالحكمة والإقناع ، والحجة والبرهان ، والموعظة الحسنة ، فليس انتشار الإسلام بالسيف كما يتصور بعضالأعداء ، وإنما كان انتشاره بالقناعة الذاتية ، وبالاستحسان الحر الطليق دون إجبار ولا إكراه : (لا إِكْراهَ فِي الدِّينِ) [البقرة ٢ / ٢٥٦].
যুদ্ধের ময়দানে এমন নির্দেশ আল্লাহ তায়ালা এজন্য দিয়েছেন, যাতে কাফেরদের সাথে আর কোন যুদ্ধ না থাকে অর্থাৎ তারা হয়তো যুদ্ধে পরাজিত হবে বা অঙ্গিকারের ভিত্তিতে অস্ত্র সমর্পণ করবে। মূলত: এ নির্দেশের চূড়ান্ত টার্গেট হল, যাবতীয় যুদ্ধ বিগ্রহের ইতিটানা। এ নির্দেশ স্বাভাবিক স্থীতিশীলতা বজায় রাখার প্রতি উৎসাহ প্রদান করার জন্য। যাতে মানুষ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে পারে এবং সুকৌশলে, সাগ্রহে, দলীল-প্রমাণ ও সদুপদেশের মাধ্যমে ইসলামের বিস্তৃতি ঘটে। ইসলামের প্রচার-প্রসার মোটেই তরবারীর দ্বারা হয়নি, যেমনটি ডাঃ কালিদাস বৈদ্য বুঝাতে চেয়েছেন বরং ইসলামের প্রচার-প্রসার লাভ করেছিল মহৎ চরিত্র এবং স্বাধীনচেতা উদার কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে। জোর-জবরদস্তির মাধ্যমে নয়। তাইতো কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, لاإكراه فى الدين দ্বীনের ক্ষেত্রে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। অন্যত্র বলেছেন, وماجعل عليكم فى الدين من حرجতিনি তোমাদের জন্য ধর্ম পালনে কোন কঠোরতা আরোপ করেননি। সূরা হজ্ব-৭৮।
ইসলাম এতটাই উদার যে, মুসলিম দেশের সংখ্যালঘু বিধর্মীদের জান-মালের নিরাপত্তার প্রতি গুরুত্বারোপ করে ইসলামের মহানবী, মানবতার কান্ডরী মুহাম্মদ সা. বলেছেন, তাদের (বিধর্মীদের) প্রাণের (নিরাপত্তার গুরুত্ব) আমাদের (মুসলিমদের) প্রাণের মতই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ধন-সম্পদের নিরাপত্তাবিধান নিশ্চিত করা আমাদের ধন-সম্পদের নিরাপত্তার মতই।
পরিশেষে আমরা দ্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, মহান আল্লাহ তায়ালা অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করার নির্দেশ দেননি। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা, সন্ত্রাসীকর্মকান্ড নির্মূল ও প্রতিহত করার জন্য কিছু কঠোর আইন ও বিধি-বিধান প্রণয়ন করেছেন। যে শত্রু অন্যায়ভাবে প্রতিপক্ষের ওপর অস্ত্রধারণ করে তাকে প্রতিহত করতে বলেছেন। তার সাথে কঠোর আচরণ করা কি অপরাধ? নাকি এটাই আইন ও নীতির দাবী।
আল্লাহর এ হুকুমগুলো অমুসলিম সন্ত্রাসীদের ব্যপারে। সন্ত্রাসী যে ধর্মেরই হোক না কেন তাকে কঠোর আইনের আওতায় আনা এটাই মানবতার দাবী। আল্লাহ বলেছেন-ولكم فى القصاص حيوة এখানে মুসলিম/ অমুসলিম সবার ক্ষেত্রেই এই হুকুম। শুধু বিধর্মী নয়। কোন মুসলিম অপরাধ করলেও তাকে আইনের আওতায় এনে হত্যা করা ইসলামেরই বিধান। তাই মুখ্য ধর্ম নয় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। সমাজে শান্তির পরিবেশ বহাল রাখার জন্য এ ব্যপারে করো ছাড় নেই।
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য তার “বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব” বইয়ের ৫৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ...
‘শিক্ষাদীক্ষায় মুসলমানদের অনীহার কারণও ইসলামের শিক্ষা। শিক্ষাদীক্ষা ও নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত সৎ মানুষ গড়ার কোনো প্রেরণা ইসলামে নেই। ইসলাম মানুষকে সম্পদ সৃষ্টিতে কোন প্রেরণা যোগায় না।”
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য লিখেছেন, "শিক্ষাদীক্ষা ও নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত সৎ মানুষ গড়ার কোনো প্রেরণা ইসলামে নেই।"
অথচ কুরআনে যে সাড়ে ছয় হাজারের বেশী বাক্য রয়েছে তার মধ্যে সর্বপ্রথম অবতীর্ণ বাক্যটি হচ্ছে ‘পড়’ তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ আর তৃতীয় বাক্যে আছে ‘পড় তোমার সম্মানিত প্রভুর নামে, যিনি তোমাদের কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।’ (সূরা আলাক্ব:১-৪)
বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, ‘প্রতিটি মুসলিমের জন্য ইল্ম বা বিদ্যা অর্জন করা ফরজ তথা আবশ্যক। সারারাত ইবাদত-বন্দেগী অপেক্ষা এক ঘন্টা জ্ঞান চর্চা করা উত্তম। যে জ্ঞানীকে সম্মান করে সে যেন আমি (নবী মুহাম্মদ)কে সম্মান করে।’ তাইতো মুহাম্মদ সা. এর জীবদ্দশায়ই আরম্ভ হয়ে পরবর্তীকালে বাগদাদ, মিশরের কায়রো, সালেনা ও কর্ডোভায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠেছে। (দ্রঃ The spirit of islam লেখক: সৈয়দ আমীর আলি, পৃষ্ঠা ৩৬১-৩৬২) আদর্শ বিদ্যানুসন্ধিৎসু দল হিসেবে মুসলিমরা ছিলেন পৃথিবীর উন্নত মার্গে (দ্রঃ History of the Arabs by Philip Hitti পৃষ্ঠা ২৪০, ছাপা ১৯৫১)
মেজর আর্থার গøীন লিনওয়ার্ড বলেন, “আরববাসীদের উচ্চ শিক্ষা সভ্যতা ও মানসিক উৎকর্ষ এবং তাঁদের উচ্চ শিক্ষার প্রণালী প্রবর্তিত না হলে ইউরোপ এখনো অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমগ্ন থাকত। বিজেতার উপর সদ্ব্যবহার ও উদারতা তাঁরা যে প্রকার প্রদর্শন করেছিলেন তা প্রকৃতই চিত্তাকর্ষক।” (দ্রঃ চেপে রাখা ইতিহাস: ১৮)
শ্রী জওহরলাল নেহেরু বলেন, হযরত মুহাম্মদের প্রচলিত ধর্ম, এর সততা, সরলতা, ন্যায়-নিষ্ঠা এবং বৈপ্লবিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সমতা ও ন্যায়নীতি পার্শ্ববর্তী রাজ্যের লোকদের অনুপ্রাণিত করে। কারণ এ সমস্ত রাজ্যের জনসাধারণ দীর্ঘদিন যাবত একদিকে শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক নিপীড়িত, শোষিত ও নির্যাতিত হচ্ছিল অপরদিকে ধর্মীয় ব্যপারে নির্যাতিত নিস্পেষিত হচ্ছিল পোপদের হাতে। (দ্রঃ চেপে রাখা ইতিহাস: ১৯)
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য অভিযোগ করে বলেছেন, ইসলামের শিক্ষা হল-জেহাদ করেপরের সম্পদ ঘরে আনতে হবে। চুরি, ডাকাতিতেই ইসলামের প্রেরণা।
ইসলামে জেহাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সত্য এবং ন্যায়বিচার পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করা, যাতে স্বার্থান্বেষী মহল পার্থিব শান্তি ও নিরাপত্তার বিঘিœত করতে না পারে। যে যুদ্ধের উদ্দেশ্য আদল ও ইনসাফ, আমানত ও সত্যবাদিতার হেফাজত এবং ঘুষ, চুরি, জেনা-ব্যভিচার, দুশ্চরিত্র, নির্লজ্জতা, অপকর্ম এবং স্বীয় হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার মূলোৎপাটন হয় তবে সে যুদ্ধ বর্বরতা নয়; বরং উচ্চাঙ্গের ইবাদত ও আল্লাহ সৃষ্টজীবের উপর অপরিসীম দয়া ও মেহেরবানি। (সীরাতে মুস্তফা (সাঃ), ২য় খন্ড, ৩৭ নং পৃষ্ঠা)
আর চুরি-ডাকাতিকে ইসলাম কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করেছে। উপরন্তু চোর ও ডাকাতের ব্যপারে ইসলাম কঠোর আইন প্রয়োগ করতে নির্দেশ করেছে। আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন,
والسارق والسارقة فاقطعوا أيديهما جزاء بما كسبا نكالا من الله والله عزيز حكيم-
চোর পুরুষ ও নারী উভয়ই হাত কেটে ফেল। তা আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে তাদের কৃতকর্মের শাস্তিস্বরূপ, আল্লাহ তায়ালা প্রবল পরাক্রমশালী, মহান প্রজ্ঞাময়। (৫:৩৩)
চোর পুরুষ হোক কি নারী, তার হাত কেটে ফেল। এ শাস্তি চুরি করা সম্পদের বিনিময়ে নয় বরং চৌর্যবৃত্তির জন্যেই এ শাস্তি যেন চোর এমনি জঘন্য অপরাধ থেকে বিরত থাকে এবং তার দেখাদেখি অন্যরাও এমন নিন্দনীয় কাজ থেকে নিবৃত্ত থাকে। (সূরা মায়েদা: ৩৮) বনূ মাখজুম গোত্রের জনৈকা মহিলা চুরির দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পর রাসূল সা. এর প্রিয়পুত্র সাহাবী উসামা বিন যায়েদ (রাযিঃ) তার দন্ড মওকুফের জন্য সুপারিশ করলে রাসূল (সাঃ) বললেন, শপথ সেই আল্লাহ পাকের; যার হাতে আমার প্রাণ, যদি মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমাও চুরি করতো, তবে আমি তার হাত কেটে দিতাম। (মুসলিম শরীফ, তাফসীরে মাজহারী, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ৪৬৬)
ডাকাতদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
إنما جزاء الذين يحاربون الله ورسوله ويسعون فى الأرض فسادا أن يقتلوا أو يصلبوا أو تقطع أيديهم وأرجلهم من خلاف أو ينفو من الأرض- ذلك لهم خزي فى الدنيا ولهم فى الأخرة عذاب عظيم-
যারা আল্লাহ তায়ালা ও তার রাসূলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং দুনিয়াতে অশান্তি সৃষ্টি করে তাদের শাস্তি এই হবে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা তাদের ফাঁসি দেয়া হবে অথবা তাদের হাত-পা বিপরীতভাবে কেটে দেয়া হবে অথবা তারা সেখান থেকে বিতাড়িত হবে। এ হলো দুনিয়াতে তাদের অপমান এবং আখেরাতে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। (৫:৩৩, তাফসীরে নূরুল কোরআন, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা- ২১২-২১৩)
আলোচ্য আয়াতে ফাসাদ বা অশান্তি সৃষ্টির যে কথা রয়েছে অনেক তাফসীরকারের মতে তার অর্থ হলো- রাহজানি বা ডাকাতি,যা বর্তমান যুগে অহরহ হতে দেখা যায়। পবিত্র কুরআনের আয়াতে এমন অপরাধের শাস্তির কথা ঘোষণা করেছে। যেহেতু ডাকাতদের অবস্থা চার প্রকার হয় তাই শাস্তিও বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন রকম ঘোষণা করা হয়েছে। (প্রাগুক্ত- ২১৫-২১৬)
ডাঃ কালিদাস বৈদ্য অভিযোগ করে বলেছেন, “ইসলামি মতে ইসলাম হল শ্রেষ্ঠ পথ।”
আমরা বলবো, শুধু ইসলামী মতেই ইসলাম শ্রেষ্ঠ নয় বরং পৃথিবীর যে কোন ধর্মের শিক্ষিত ও বিদ্বান ব্যক্তিদের মত এটি। অধ্যাপক শান্তিভূষণ বসু বলেছেন- ‘পৃথিবীর সর্বাধুনিক ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মের নাম ইসলাম ধর্ম। বহু পÐিতের মতে একমাত্র ইসলাম ধর্মই কার্যকরীভাবে মানুষের মনুষ্যত্ব রক্ষায় তৎপর...” (দ্রঃ চেপে রাখা ইতিহাস: ৩২, ৯ম সংস্করণ ২০১৪ ইং, মাকতাবাতুত তাকওয়া, বাংলাবাজার, ঢাকা)
ভারতীয় নেতা শ্রী করম চাঁদ গান্ধী বলেন, প্রতীচ্য যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রাচ্যের আকাশে তখন উদিত হল এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং আর্ত পৃথিবীকে তা দিল আলো ও স্বস্তি। ইসলাম একটি মিথ্যা ধর্ম নয়। শ্রদ্ধার সাথে হিন্দুরা অধ্যয়ন করুক তাহলেই আমার মত তারা একে ভালবাসবে। (প্রাগুক্ত: ২০)
(ডাঃ কালিদাস বৈদ্যের বই ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব’- এর পিডিএফ কপি ইন্টারনেটে পেতে হলে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব লিখে সার্চ করুন।)